২০১০ সালে টিআইবি’র আলোচিত প্রতিবেদন নিয়ে লেখা। যায়যায়দিনে ছাপা হয়েছিল।
টিআইবির একটি প্রতিবেদন নিয়ে এখন হই চই চলছে দেশের বিচার বিভাগে। সরকারি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, দেশের আইনজীবীরা এমনকি বিচারকরাও আপাত একসুরে কথা বলছেন বলেই মনে হচ্ছে। সেবা খাতের দুর্নীতি নিয়ে চালানো একটি জরিপের ফলাফল ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত জরিপ চালানো হয় ৬৪ জেলার ৬ হাজার পরিবারের ওপর। সেবা খাতের মধ্যে বিচার বিভাগেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে টিআইবির জরিপের ফলাফলে দেখা যায়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেন সবচেয়ে বেশি হয় উচ্চ আদালতে।
জরিপে উল্লেখ করা হয়, প্রতি পরিবারকে গড়ে ৭ হাজার ৯১৮ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে বিচার বিভাগে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে উচ্চ আদালতে। জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারকে ঘুষ দিতে হয় হাইকোর্টে, ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশকে হাকিম আদালতে এবং ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবারকে ঘুষ দিতে হয় জজ আদালতে। প্রতি পরিবারকে গড়ে ঘুষ দিতে হয় ১২ হাজার ৭৬১, হাকিম আদালতে গড়ে ৬ হাজার ৫৯৮ এবং জজ আদালতে ৬ হাজার ১৭৮ টাকা। জরিপে অংশ নেয়া ৮৮ শতাংশ পরিবার বিচার বিভাগের দুর্নীতির শিকার বলে দেখা যায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতির শিকার ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার। সেবা খাত নিয়ে জরিপে অংশ নেয়া ৭১ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার ভূমি প্রশাসনের, ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার কর ও শুল্ক প্রশাসনের এবং ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার বিদ্যুৎ সেবার দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে জরিপে দেখা যায়।
জরিপের ফলাফল প্রকাশের পর থেকে সরকারি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা টিআইবির এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করছেন। আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এটাকে বলছেন বিভ্রান্তিকর, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া দেখছেন সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। আর আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চায় টিআইবি পরোক্ষভাবে তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রতিবাদমূলক বক্তব্য এসেছে পুলিশের পক্ষ থেকেও। আইনজীবীরাও বক্তব্য দিয়েছেন। কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামে টিআইবির বিরুদ্ধে মানহানি মামলা হয়েছে। মামলা করেছেন আইনজীবীরা। ‘টিআইবির রিপোর্টে বিচার বিভাগকে হেয় করা হয়েছে, আর আইনজীবীরা বিচার বিভাগের অংশ, তাই তাদেরও মানহানি হয়েছে’- মামলার বক্তব্য এমনই। চট্টগ্রামের মামলায় সমন আর কুমিল্লার মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম হাফিজউদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও সিনিয়র ফেলো ওয়াহিদ আলমের বিরুদ্ধে।
বিচার বিভাগ দুর্নীতির আওতামুক্ত- এমন দাবি কিন্তু কেউই করছেন না। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে যখন দুর্নীতির বিচরণ তখন বিচার বিভাগ নিয়ে এমন দাবি করার আসলে সুযোগও নেই। অতীতেও নানা সময়ে বিচার বিভাগ নিয়ে এ কথাগুলো এসেছে। এবারই প্রথম অতিমাত্রায় তথ্যনির্ভর প্রতিবেদন হাজির করাতেই এত হই চই। একটা প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মেনে নিতে প্রচ- অনীহা। সরকার-আইনজীবী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের বক্তব্যেও এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, তারা টিআইবিকে দেখে নিতে চান কোন সাহসে টিআইবি এমন প্রতিবেদন দিল। সত্যিই যে বিচার বিভাগের প্রতিটি পর্যায়ে অহরহ দুর্নীতি হচ্ছে এবং তার মাত্রা ভয়াবহ সেটি মেনে নিয়ে তা কমানোর কোনো পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নন কেউ। সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই প্রতিবেদনকে তারা আওয়ামী লীগের একটা দায় হিসেবেই দেখছেন এবং তা মেনেও নিচ্ছেন। কিন্তু এই দায়টা তো কোনো একক রাজনৈতিক দলের না। এই দায়টা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের। বিচারের সামগ্রিক ব্যবস্থার, পদ্ধতির। বিচার পদ্ধতির সংস্কারের যেই জায়গাটায় আলোচনা শুরু হওয়া দরকার, সেখানে কেউ উদ্যোগী বা আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে দেশের আইনজীবীদের নানাভাগে ভাগ হয়ে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আওয়ামী বা বিএনপিপন্থী বলে আইনজীবীদের বক্তব্য এখানে আলাদা হয়নি। সবাই মোটামুটি একই সুরে কথা বলছেন। টিআইবির বিরুদ্ধে আইনজীবীদের দায়ের করা মামলা আমলে নিয়ে বিচারকরাও এই দলে যোগ দিয়েছেন। বিচার বিভাগের জন্য এ সুরটা খুব জরুরি। তবে সেটা টিআইবিকে দেখে নেয়ার জন্য বা টিআইবির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার কাজে ব্যবহার করলে চলবে না। এতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি বাড়বে না। বিচারক-আইনজীবী-সরকারের এ সম্মিলিত সুর বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করে এর ন্যায়বিচার-বান্ধব পরিবেশ প্রতিষ্ঠার দিকেই অগ্রসর হতে হবে। তবেই কেবল সাধারণ জনগণ অর্থাৎ বিচারপ্রার্থীরাও একই সুরে কথা বলবে। আর টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠানেরও কাজের আওতা কমে আসবে।