বাটোয়ারা মামলার জটিলতা
মূল মামলাটি শুরু হয় ১৯৮০ সালে। বাটোয়ারা মামলা। বাদীর নাম খুদু প্রামানিক। অল্প জমি নিয়ে মামলা। মাত্র ২৮ শতাংশ, ৪টি দাগে। বাদী খুদু প্রামানিক দাবী করেন যে, তিনি ওয়ারিশ সূত্রে ও কবলা মূলে ২৩.৭৫ শতক জমিতে মালিক। যার মধ্যে ১ শতাংশ জমি সরকারি রাস্তায় একোয়ার হয়েছে। তিনি ২২.৭৫ শতাংশ জমির ছাহাম চেয়েছেন। মূল মামলায় ১ নং বিবাদী করা হয় জয়নাল আবেদীনকে, যার দাবী ছিল ক্রয়সূত্রে ২ শতাংশ জমি। আর ২ নং বিবাদীর দাবী ছিল ৭.৫ শতাংশ জমি।
ট্রায়াল কোর্ট মামলাটি ডিসমিস করে দেন। বাদীপক্ষ আপীল করেন ১৯৯৪ সালে। আপীল আদালত ২০০০ সালের আগস্ট মাসে ট্রায়াল কোর্টের রায়-ডিক্রিকে বাতিল করে আংশিক আপীল মজ্ঞুর করেন; কিন্তু সবার মাঝে ঠিকঠাক বাটোয়ারা করতে পারেন নি। যার বিরুদ্ধে ২০০১ সালে সিভিল রিভিশন হয় হাইকোর্ট বিভাগে।মামলাটা জটিল। বেশ জটিল। কিন্তু ইন্টারেস্টিং।
২৮ শতাংশ জমির সিএস খতিয়ানভুক্ত মালিক ছিলেন তিনজন। আবির প্রামানিক, যার পিতার নাম কাদির প্রামানিক, তিনি ৮ আনা অংশে ১৪ শতাংশের মালিক ছিলেন। আর তবিয়া প্রামানিকের দুই ছেলে সোনা প্রামানিক ও পোনা প্রামানিক উভয়ে ৪ আনা অংশে ৭ শতাংশ করে মালিক। মোট ২৮ শতাংশ জমি মিলে গেল।
আবির প্রামানিক মারা যায় স্ত্রী সায়মন বেওয়া ও পুত্র সলিমউদ্দিনকে রেখে। সলিমউদ্দিন বিয়ের আগেই মারা যায়। তার ওয়ারিশ থাকে মা সায়মন। সায়মন মারা যাওয়ার সময় ওয়ারিশ রেখে যায় তার ভাই মোজাহার ও বোন করিমনকে।
অন্যদিকে সোনা প্রামানিক মারা যায় শুধুমাত্র ভাই পোনা প্রামানিককে ওয়ারিশ রেখে। এরপর পোনা মারা যাওয়ার সময় ওয়ারিশ রেখে যায় তার স্ত্রী জরিনা, পুত্র জয়নাল ওরফে বিশু এবং কন্যা জমিরনকে।
জমিরনের বিয়ে হয় বাদী খুদু প্রামানিকের সাথে। জমিরন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার ওয়ারিশ থাকে ভাই জয়নাল ওরফে বিশু এবং স্বামী খুদু প্রামানিক।
মৃত পোনা প্রামানিকের স্ত্রী জরিনা আবার বিয়ে করেন রিয়াজকে। সেখানে তাদের দুই পুত্র সন্তান আবদুল এবং আবদুল কুদ্দুস জন্মলাভ করে। জরিনা মারা যাওয়ার সময় ওয়ারিশ রেখে যায় পুত্র জয়নাল ওরফে বিশু (প্রথম স্বামী পোনা প্রামানিকের ঔরষে), দ্বিতীয় স্বামী রিয়াজ, এবং অপর দুই পুত্র আবদুল ও আবদুল কুদ্দুসকে (স্বামী রিয়াজের ঔরষে)।
রিয়াজ মারা যাওয়ার সময় ওয়ারিশ রেখে যান আবদুল ও আব্দুল কুদ্দুস (জরিনার গর্ভে) সহ আরো তিন পুত্র অর্থাৎ মোট ৫ জন পুত্র, ৩ জন কন্যা ও ১ জন স্ত্রী।
আমাদের ক্লায়েন্টের লিংক কোথায়? এই যে জরিনা আর রিয়াজের ছেলে আবদুল এবং আবদুল কুদ্দুস, তাদের থেকে ২টি দলিলে মোট ২ শতাংশ জমি কেনে জয়নাল আবেদীন। ১৯৮০ সালে, মূল মামলা দায়েরের আগে। এরপর তিনি মামলা প্রতিদ্বন্দিতা করেন। আপীল শেষ হওয়ার পর রিভিশন ফাইল হওয়ার আগে তিনি আমাদের ক্লায়েন্টদের পূর্ববর্তী মিস্টার রফিক উল্লাহর কাছে ২০০০ সালে সেই ২ শতাংশ জমি বিক্রি করেন।
বাদী খুদু প্রামানিক তার স্ত্রী জমিরন থেকে কিছু সম্পত্তির ওয়ারিশ হন। এছাড়া তিনি ৩টা দলিল মূলে জমি কেনেন তার মৃত স্ত্রীর ভাই জয়নাল ওরফে বিশু থেকে। ১টা দলিলে জমি কেনেন আবির প্রামানিকের স্ত্রী সায়মনের ভাই মোজাহার ও বোন করিমনের নিকট থেকে। আর ১টা দলিল মূলে ১ শতাংশ জমি ক্রয় করেন আব্দুল ও আবদুল কুদ্দুস ছাড়া রিয়াজের অন্যান্য ওয়ারিশদের থেকে।
জটিলতা শুরু হচ্ছে। মাত্র। এইযে এত এত লোক বিভিন্ন দলিল মূলে যত জমি বিক্রি করে দিল, এরা আদতে এত পরিমান জমির মালিক হয় না।আর এর বাইরেও সকল হিসাব-নিকাশ উল্টে যাওয়ার মতন একটা ট্রাম্প কার্ড রয়ে গেছে।
আবার গোড়ায় যাই। সিএস রেকর্ডীয় তিন মালিক আবির প্রামানিক, যার পিতার নাম কাদির প্রামানিক; আর সোনা প্রামানিক ও পোনা প্রামানিক, যাদের পিতার নাম তবিয়া প্রামানিক। কিন্তু আবির প্রামানিকের সাথে সোনা ও পোনা প্রামানিকের কোন ক্লিয়ার-কাট সম্পর্ক আছে কিনা, সেটি দেখার বিষয়।
কারণ আবির প্রামানিক মারা যাওয়ার স্ত্রী সায়মন ও পুত্র সলিমউদ্দিনকে ওয়ারিশ রেখে যায়। সলিমউদ্দিন বিয়ের আগেই মারা যায়। আবির প্রামানিকের সাথে উপরের দিক থেকে যদি পোনা প্রামানিকের কোন সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে সলিমউদ্দিন মারা যাওয়ার সময় শুধুমাত্র তার মা সায়মন ওয়ারিশ থাকে না।
সলিমুদ্দিন মারা গেলো মা সায়মন কোরানিক শেয়ারার হিসাবে তিন ভাগের একভাগ সম্পত্তি পায়। অন্য কেউ না থাকায় বাকী সম্পত্তি তার পিতার দিকে অর্থাৎ উপরের আত্মীয়দের দিকে ফিরে গিয়ে আবার নিচের দিকে নেমে আসবে এবং পোনা প্রামানিক আসাবা বা অবশিষ্টাংশভোগী হিসাবে ওয়ারিশ হবে।
তাহলে দ্বিতীয় এ্যানাজলিতে আমরা ভাবতে পারি সলিমউদ্দিনের বাবা আবির প্রামানিক, তার বাবা কাদের প্রামানিক, তার বাবা নাম না জানা একজন, ধরি ‘ক’ প্রামানিক। এই ‘ক’ প্রামানিকের পুত্র হলো তবিয়া প্রামানিক, তার পুত্র হলো পোনা প্রামানিক। এই এ্যানালজিতে সলিমউদ্দিনের পিতার পিতার পিতার পুত্রের পুত্র হয় পোনা প্রামানিক। মানে চাচা-ভাতিজা সম্পর্ক।
তবে দুইটি এ্যানালজির যেটাই হোক না কেন, সলিমউদ্দিনের ওয়ারিশ হিসাবে মা সায়মন বেওয়া তিনের এক অংশ পাওয়ার পর বাকীটা পিতার পিতার পুত্রের পুত্র অথবা পিতার পিতার পিতার পুত্রের পুত্র হিসাবে পোনা প্রামানিক আসাবা হিসাবে ইনহেরিট করবে। মুসলিম ইনহেরিটেন্স ল’ এটাই বলে।
এখন অধস্তন দুইটা আদালতের রায়, প্লিডিংস আর সাক্ষ্য-দলিলাদি ঘেটে আমরা এর সমর্থনে বেশ কিছু প্রমাণ পেলাম। সেগুলো একত্রে জড়ো করলাম।
তো, আমরা সলিমদ্দিনের সাথে পোনা প্রামানিকের একটা সম্পর্ক দেখালাম। কিন্তু এইখানে আসল কষ্ট না। আসল কষ্ট হলো, আমাদের ক্লায়েন্টের কেনা ২ শতাংশ জমি কোন হিসাবেই টিকবে না। কমে যাবে। আবদুল ও আবদুল কুদ্দুস যে পরিমান জমির মালিক হয়, তার চেয়ে বেশি তারা বিক্রি করেছেন।
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ভার্চুয়াল একটি বেঞ্চে এই রিভিশন মামলাটির শুনানি শুরু হয়েছিল। এত এত জটিলতা দেখে আদালত বলেছেন, এই মামলা ভার্চুয়ালি নিষ্পত্তি করতে অসুবিধা হবে। একচুয়াল কোর্টে আসেন।
অনেক মাস পরে এই মামলাটি আবার ফিজিক্যাল কোর্ট চালু হওয়ার পর শুনানির কার্যতালিকায় আসে। আমরা হিয়ারিং করি, সিনোপসিস করে কোর্টে জমা দেই। মহামান্য আদালত আমাদের সাবমিশন গ্রহণ করে সম্পত্তি বাটোয়ারা করে দেন। আমাদের দেখানো মতেই আমাদের ক্লায়েন্টের জমি কমে যায়।
সিনিয়র আমাকে বলেন, ‘জহির, ক্লায়েন্টকে জিতিয়ে আনা আইনজীবীর কাজ না, আইনজীবীর কাজ হলো আদালতকে সত্য নির্ধারণে সহায়তা করে ন্যায়বিচারে অবদান রাখা’।