ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিরসরাই পার হয়ে বড়তাকিয়া বাজার। তার কিছু পরেই নয়দুয়ারী। মহাসড়ক থেকে গ্রামের দিকে নেমে গেছে ছোট রাস্তা। অল্প কয়েকটা দোকান-পাট নিয়ে এখানে বাজার গড়ে ওঠেছে। নয়দুয়ারী বাজার জায়গাটা কম পরিচিত। গুগল ম্যাপেও বাজারটা পাওয়া গেলো না। তবে পাওয়া গেলো রাস্তার ঠিক বিপরীত দিকে নয়দুয়ারিয়া মসজিদ। খুব সকালে আমরা আটজন নয়দুয়ারী বাজারে চট্টগ্রামগামী বাস থেকে নেমে গেলাম।
তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। কিশোর থেকে মাঝবয়সী কিছু লোক সেখানে ছাতা মাথায় দাড়িয়ে আছে। এরা “লোকাল গাইড”। নাপিত্তাছড়া ট্রেকিংয়ে তারা ট্রেকারদের গাইড করে। কয়েকজনের আগে থেকেই ট্রেকারদল ঠিক করা আছে, যেমন আমাদের গাইড মামুন। আর বাকীরা এখানে যারা নামবেন, তাদের গাইড হওয়ার চেষ্টা করবেন। তিনশ’ টাকা থেকে দরাদরি শুরু করে তারা রাজি হয়ে যায়।
আমরা গ্রামের ছোট রাস্তায় হাটা শুরু করলাম। লোকালয়, সবুজ ধানক্ষেত আর দূরে আবছা পাহাড়। অসংখ্য টিয়া পাখির দেখা পেলাম। হাটতে হাটতে পেয়ে গেলাম রেললাইন। কয়েকটা দোকান আছে। সকালের নাস্তা করলাম। রেললাইন পার হতেই আমাদের গাইড মামুন ভাইয়ের বাড়ি। গ্রামের বাড়ি যেমন হয় আর কি। বড় পুকুর, উঠোন, মাটির ভিটেয় একতলা টিনের ঘর। সেখানে আমরা শহর-পালানো ট্রেকারদল ‘ফ্রেশ’ হয়ে ট্রেকিং-বান্ধব পোষাক পরে ভারী ব্যাগ রেখে ‘রেডি’ হলাম। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আমরা মাটির ছোট রাস্তা দিয়ে আবার হাটলে লাগলাম।
উচুঁ সবুজ পাহাড়ে আমরা মিশে যাবো। তার আগে ক্ষেত আর সবজি বাগান আমাদের জন্য আরেক সবুজের বিছানা পেতে রেখেছে। আমরা স্বর্গীয় পথে এগোতে এগোতে পাহাড়ের দেয়াল ঘেষে থামলাম। সেখানে একটা খাবার দোকান, পাহাড়ে হারিয়ে যাওয়ার আগে এখানে খাবার অর্ডার করতে হয়।
ট্রেইলের সবচেয়ে সুন্দর এই ঝিরি পথ।
আর রাস্তা নেই। পাহাড় থেকে বেরিয়ে একটা ঝিরি বয়ে যাচ্ছে। সেখানেই নেমে গেলাম। স্রোতের বিপরীতে পাহাড়ের ভিতরে হাটতে লাগলাম, উদ্দেশ্য এই ঝিরির পানির উৎসে যাওয়া। নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের প্রথম ঝর্ণা–কুপিকাটা খুম। পাহাড়ের উচুঁতে কিছু লোকালয় পেলাম, খাশিয়া উপজাতি থাকে। পাহাড় ঘিরেই তাদের জীবন-জিবীকা। এই ঝিরির পানি পরিষোধন করেই তারা পান করে। প্রাকৃতিক পদ্ধতির ফিল্টারিংয়ের কিছু পদ্ধতিও আমরা দেখতে পেলাম।
ঝিরিপথের ঠান্ডা পানিতে হাটতে হাটতে পুরো শরীরে একটা ঠান্ডা প্রশান্তি ছড়িয়ে পরছিলো। বড় বড় পাথরের দেখা পাচ্ছিলাম। দুর্গম আকা-বাঁকা পথে এগোতে এগোতে ঝর্ণার শব্দ কাছে আসতে লাগলো। এক পর্যায়ে পেয়ে গেলাম নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের প্রথম ঝর্ণা কুপিকাটা খুম। তখন সকালের সূর্যের আলো তাপ ছড়ানো শুরু করেছে।
কুপিকাটাখুম।
পাথরের প্রশস্ত পাহাড়ের উচ্চতা বেয়ে ধেয়ে আসছে পানির ঢল। দৃষ্টিনন্দন কুপিকাটাখুমের প্রথম স্তর। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠলে বিশাল ছাদ। দুর্দান্ত জায়গা। তার উপরের দিকে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা স্তর বেয়ে ধেয়ে আসছে জলস্রোত। আরো উপরে সরু গুহা, তার উপর থেকে প্রচন্ড গতিতে বেশ উচুঁ থেকে আসছে পানি। এই জায়গায় সাঁতরে যেতে হয়। চমৎকার এক্সাইটমেন্ট।
কুপিকাটা খুম থেকে আরো একটা বড় পাহাড় ট্রেকিং করে উপরে উঠতে হলো আমাদের। সেই পাহাড়ে হেটে হেটে আবার নামলাম ঝিরি পথে। এই পথটা অনিন্দ্য সুন্দর। বর্ণনায় ধরা যায় না। দুই পাশে উঁচু পাহাড়, একটু পর পর বড় বড় পাথর। আর পুরাটা হাটার পথ শক্ত পাথরে বাঁধাই করা। তার ওপর দিয়ে ঝিরি ঝিরি পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কলকল শব্দ। এই পথে হাটতে অপার্থিব সুখ।
ঝিরিপথ।
পুরো ট্রেইলে এই পথটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছে। এমনকি ঝর্ণাগুলো থেকেও। অনেকদূর এগিয়ে দুইদিকে চলে গেছে এই ঝিরি পথ। আমরা বামদিকে এগুতে থাকলাম। আরো পরে পেয়ে গেলাম ট্রেইলের সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা–বাঘবিয়ানী।
ত্রিভুজাকৃতির পাথরের পাহাড়। অনেক উঁচু থেকে ধেয়ে নামছে পানির ধারা। অপূর্ব সুন্দর। পানির গতি প্রচন্ড। বাঘবিয়ানী নামটাও যেমন সুন্দর, ঝর্ণাটা এবং এর আশপাশও অনেক সুন্দর।
বাঘবিয়ানী ঝর্ণা।
আবার ঝিরি পথে ফেরত এসে চলে গেলাম নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের সর্বশেষ ঝর্ণা–বান্দরীখুম। এই ঝর্ণাটা দৃষ্টিনন্দন এবং বেশ প্রশস্ত, কিন্তু পানির গতিবেগ কম।
এরপর নেমে আসার পালা। আবার সেই স্বর্গীয় ঝিরি পথে মারিয়ে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা। সেখানে পাহাড় দেয়াল হয়ে ছিলো, সেইখানে আগেই অর্ডার করা হোটেলে এসে দুপুরের খাবার খেলাম। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত কিন্তু পরিতৃপ্ত আমরা।
এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে ছোট রাস্তায় না হেটে সবুজ ক্ষেতের আইল দিয়ে হেটে এসেছি। এইটার সৌন্দর্য অসাধারণ। পিছনে পাহাড়। রোদ খেলা করছে। চারিদিকে সবুজের আস্তরণ। মাঝখান দিয়ে হেটে চলেছি আমরা।
এই হাটা যদি শেষ না হতো। এই পথে যদি অন্তহীন হাটতে পারতাম।
Leave a Reply