উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র সারোয়ার চাঁদপুর কলেজের ফুটবল টিমের গোলকিপার, মিঠাপুকুর গ্রাম থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সারোয়ার পড়াশুনায় ‘এলিট’ মেধাবী ছিল না। ডিগ্রি পাশ সারোয়ারের বর্তমান পোর্টফোলিও বেশ বড়। দেশের অন্যতম বড় গার্মেন্টস গ্রুপের একজন ডিরেক্টর। মধ্যবিত্ত জীবনের সকল স্বপ্ন তার পূরন হয়েছে ইতোমধ্যেই। অতি-উচ্চ বংশের শিক্ষিত মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে, ঢাকার অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট হয়েছে, গাড়ি হয়েছে, ব্যবসায়িক কাজে পৃথিবীর বহু দেশ ঘোরা হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের টেনে তোলার চেষ্টা করছেন, মোটামুটি পর্যাপ্ত টাকা হয়েছে। সবমিলিয়ে তার ক্লাস চেইঞ্জ হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? সারোয়ার কি তার মধ্যবিত্ত হীণমন্যতা ত্যাগ করতে পেরেছে? উচ্চবিত্ত সমাজ কি সারোয়ারকে তাদের সদস্য মনে করে? সবচেয়ে বড় কথা সারোয়ার কি মনে করে নিজেকে?
অথচ সারোয়ারের এসব হওয়ার কথা ছিল না। ১৪ বছর আগে একদিন ঘটনাচক্রে সরোয়ার নিজের অনেক যোগ্যতা-দক্ষতার ব্যাপারে জানতে পারে। লেখক জিয়া হাসান বলছেন, সেটা ছিল সরোয়ারের জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনা থেকেই সারোয়ারের উত্থান। নিজের পরিশ্রম, যোগ্যতা, আর নানান দক্ষতার সমন্বয়ে সারোয়ার উঠেছে। ভাগ্য সেখানে ছিল সহায়ক হয়ে।
উপন্যাসটি সারোয়ারের বর্তমান সময়ের দু’টো দিনের ঘটনা প্রবাহ। সারোয়ারের মহাব্যস্ত জীবনে অখন্ড সময় আসেনি ভেবে দেখার, পিছনে ফিরে তাকানোর। সে শুধু তরতর করে উপরে উঠতে চেয়েছে। উঠেছেও। পরিবর্তন করতে চেয়েছে নিজের শ্রেণি চরিত্রের। মিশে যেতে চেয়েছে উপরের সমাজের সাথে। কিন্তু তাকে যে কত কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে, তা ভেবে দেখার ফুসরৎ হয়নি কখনো। ভেবে দেখার প্রয়োজনবোধও করেনি পেশাদার সারোয়ার। তাইতো এখন সে মহাবিপদে পড়ে দেখতে পাচ্ছে, সে আসলে একা। সে আসলে মিঠাপুকুর গ্রামের সারোয়ার। সে আসলো চাঁদপুর কলেজের গোলকিপার সারোয়ার। তার কেউ নেই, তার বাড়ি নেই। তার স্ত্রী আছে, না ফেরার দূরত্বে। তার মেয়েদের সে কাছে পায় না। বাংলাটেক্সের কেউ তার না। সে আসলে অসহায়।
সারোয়ারের চরিত্র নির্মাণে সবচেয়ে বেশি সময় নিয়েছেন লেখক। তাকে দেখিয়েছেন সৎ-পরিশ্রমী-পেশাদার হিসাবে। আসলে কি সরোয়ার সৎ? সততার নানান ধরণ আছে। স্ত্রী-সন্তানদের সাথে সৎ থাকতে হয়, নানান পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কে সৎ থাকতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা নিজের কাছে সৎ থাকতে হয়। সারোয়ারের মধ্যে শুধু নিজের পেশাগত কাজের প্রতি নিরঙ্কুশ কমিটমেন্ট দেখা যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে পাঠককে তার সততা ঘুঁজতে হয়। আসলে আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সরোয়ার একজন ‘ভেরি গুড’ দাস। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা, উচ্চবিত্ত বেনিয়ারা, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি-কর্পোরেটরা যেধরণের এমপ্লয়ি তৈরি করতে চায় সারোয়ার তার আদর্শ উদাহরণ।
উপন্যাসটি সুখপাঠ্য। বর্ণনাভঙ্গি সরল। আমরা যারা জিয়া হাসানের অনলাইনে লেখালেখির সাথে পরিচিত তারা জানি জিয়া হাসানের লেখায় একটা মোহনীয়তা আছে। তিনি পাঠক ধরে রাখতে পারেন। যা বলতে চান সরাসরি বলে ফেলেন, ভনিতা নাই। প্যাচ-গোজ নাই। উপন্যাসটিতেও তিনি ভনিতা করেন নাই। যখন যা বলার দরকার ছিল, সোজা বলে দিয়েছেন। পাঠক হিসাবে এখানেই সবচেয়ে বড় আরাম হয়। লেখকের উপর নির্ভরতা বাড়ে। বিশ্বাস জন্মে। এরপর লেখক তার পাঠককে নিয়ে তার ইচ্ছামত সফর করতে পারেন। জিয়া হাসান এখানে সফল। তার বর্ণনায় ঘাটতি কম। পাঠক হিসাবে পাঠ করতে করতে যখন মনে হবে, এখন একটু সিনহা সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার, পাঠকের যখন এসআই হাশেমের ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করবে, সাংবাদিকের ব্যাপারে আগ্রহ হবে, শাহিদার মনের কাছাকাছি যেতে ইচ্ছা করবে, জিয়া হাসান ঠিক তখনি পাঠককে নিয়ে সেখানে যাবেন।
সবমিলিয়ে দুর্ঘটনায় কবি আসলে একটি হতাশার গল্প, ক্ষোভের গল্প, জীবনের সাথে মন খারাপ করে মানিয়ে নেওয়ার গল্প। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলোর লাইফস্টাইলের মধ্যে জীবন দর্শনের মধ্যে হতাশা দেখা যায়। ক্ষোভ দেখা যায়। বৈপরীত্ব দেখা যায়। সাংবাদিকের কেন টাকা নাই, সেজন্য তার হতাশা আছে। আবার ফকিন্নির পুত সরোয়ারের কেন এত টাকা হইলো, এ নিয়া সাংবাদিকের জেলাসি আছে। সেই টাকা থেকে কেন সাংবাদিককে দেয় না, সেই ক্ষোভ আছে। এসআই হাশেমের পুলিশের চাকুরী করার কোন ইচ্ছাই ছিল না। সে হতে চেয়েছে গায়ক, গীতিকার। এখনো সে গান বান্ধে, সুর দেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশি চাকুরী নিয়া তার বিরক্তি আছে, নিজের গানের প্রতিভায় এখনো আস্থা আছে। জমিদার বংশের রক্ত নিয়েও শাহিদার দেমাগ নাই, কিন্তু নিজের যোগ্যতায় কিছু একটা না করার আফসুস আছে।
লেখক আবার চরিত্রগুলোর মানবিক দিকের একটা ছবি এঁকে দিতে চেয়েছেন। একই সাথে চরিত্রগুলোর অসসতা আড়াল করেন নাই। সরোয়ারের একটা কোমল মন আছে, সে চায় তার ফ্যামিলি ভাল থাকুক আবার চায় ড্রাইভার ছটু একটু আরামে থাকুক। এ্যাকসিডেন্টে আহত পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য তার মন কান্দে। যমজ মেয়ে জরি-পরির সাথে সময় কাটাতে না পারায় কষ্ট পায়। শাহিদাকেও আবার খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু আবার এই সরোয়ার পুরোদস্তুর প্রফেশনাল। পেশাদারির স্বার্থে সবকিছুকে চাপা দিতে বুক কাঁপে না। তার কোম্পানী জমিদখলসহ নানান আকামে জড়িত সে জানলেও নিজে যেহেতু সেগুলা ডিল করে না, তাই তার দায় নাই বলে নিজের কাছে সৎ থাকার চেষ্টা করে। সাংবাদিক সারাদিন ধান্ধা করে ঠিকই আবার তার মা-মরা ছেলেকে আগলে রাখে, রাতে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সে যেহেতু অনেক বড় বড় লোকের দুই নম্বরির খবর জানে, তাই তাদের থেকে টাকা খাওয়াটাকে নাজায়েজ মনে করে না। এসআই হাশেম নিজে ঘুষ খায় না, কিন্তু কেউ তাকে খুশি হয়ে দিলে সে না করেনা। আবার দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করতে গিয়া কাউরে মারতেও তার খারাপ লাগে না। শাহিদার সারোয়ারের প্রতি ঘেন্না জন্মেছে, নিজের ব্যক্তিত্ব আছে, আবার বাপের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়া সরোয়ারের টাকা সরাইতে আপত্তি নাই। সবাই যার যার মত করে নিজের ব্যাখ্যা গুছিয়ে রাখে।
পুরো উপন্যাস একটানে পড়ে ফেলার মতো। সাসপেন্স আছে। প্রশ্ন হাজির আছে। সর্বশেষ লাইন পড়ার আগে শেষটা বোঝার উপায় নাই। শেষে কি পাঠক আহত হবে? অন্যভাবে কি শেষ হতে পারতো? অবশ্যই পারতো। কিন্তু লেখকের এই দায় নাই। তিনি হঠাৎ করে শেষ করেন নাই। পুরো উপন্যাসজুড়ে গ্রাউন্ড তৈরি করেছেন। তবে ঠিক এভাবেই শেষ হবে বলে পাঠক আন্দাজ করতে পারেন না। কেউ কেউ ধাক্কা খান। কিন্তু আসলে এটাই শেষমেষ সারোয়ার। মধ্যবিত্ত সারোয়ার।
শেষে কি লেখক পাঠককে কষ্ট দিয়েছেন? সারোয়ারকে এভিল বানিয়েছেন? হয়তোবা, নয়তো না। তবে জিয়া হাসান বলেছেন এটাই তার প্রথম ও শেষ উপন্যাস। এইটা পাঠক হিসাবে আমাদের জন্য মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমরা আশা করি তিনি আরো লিখবেন। তিনি না লিখলে তার লেখার চমৎকার ক্ষমতার প্রতি অবিচার করা হবে।
দুর্ঘটনায় কবি
লেখক: জিয়া হাসান
প্রকাশক: আদর্শ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৬
Leave a Reply