(২০১১ সালের লেখা। যায়যায়দিনে প্রকাশিত)
বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ১৯৮৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮৯ প্রকাশিত হয়। এরপর দুদফায় আইনটির সংশোধন হয়। প্রথমবার ১৯৯২ সালের ২২ নাম্বার এবং শেষবার ২০০১ সালের ১৭ নাম্বার আইন দ্বারা। আইনটিতে মোট ৯টি ধারা আছে। ৪ নাম্বার ধারার নিয়ম অনুযায়ী ইটের ভাটা স্থাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে দরখাস্ত করতে হয়। কোনো ব্যক্তি ইটের ভাটা স্থাপন করার জন্য দরখাস্ত করার পর জেলা প্রশাসক চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবেন। কমিটিতে থাকবেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা যেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নেই সেখানে বন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এ কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে, যার ওপর লাইসেন্স পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করবে। আর লাইসেন্স তিন বছরের জন্য বৈধ থাকবে। বেশ ভালো কথা, ভালো নিয়ম।
কিন্তু সমস্যা হলো, একই আইনের ৯ ধারায় দেয়া ক্ষমতাবলে প্রণীত ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ১৯৮৯-এর নিয়ম নিয়ে। এ বিধিমালাটি বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালের ২১ ডিসেম্বর। এ আইনের বিধি ২ অনুযায়ী ইটের ভাটা স্থাপনের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হয় সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে। আর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লাইসেন্স দেয়ার পর তার বৈধতা থাকবে পাঁচ বছরের জন্য। অথচ মূল আইনে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে বলা হয়েছে। আর লাইসেন্সের বৈধতার মেয়াদ দেয়া হয়েছে তিন বছর।
আমাদের দেশে অনেক বিষয়েই বিশেষায়িত আইন রয়েছে। ইট পোড়ানোর জন্য আইন তেমনি একটি বিশেষায়িত আইন। পরিবেশ আইনের একটি অংশ হিসেবে ইট পোড়ানোর নিয়ম নিয়ে এ আইনটি তৈরি করা হয়। তবে এ আইন এবং এর অধীনে তৈরিকৃত বিধিমালার নিয়ম পুরোপুরি বিপরীত। আইন এবং বিধিমালার মধ্যে এমন বিপরীতধর্মী বক্তব্য কেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, কীভাবে এমন বিপরীত বিধান নিয়ে এত বছর ধরে এগুলো বিদ্যমান রয়েছে। আইন এবং বিধি যারা খসড়া এবং চূড়ান্ত করেছিলেন তাদের আন্তরিকতার যে যথেষ্ট অভাব ছিল সেটি স্পষ্ট। যারা এ আইনের অধীনে কাজ করতে যান বা প্রতিকার প্রত্যাশা করেন তারা যে অসুবিধায় পড়েন সেটা যেমন সত্যি, তেমনি এ আইন এবং বিধি যারা প্রয়োগ করেন তারাও যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন সেটিও সত্যি।
ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইনের আরো অনেক নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। আইনটির ৫ ধারায় ইট পোড়ানোর জন্য জ্বালানি কাঠের ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর ২(ক)(ক) এ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জ্বালানি কাঠ অর্থ বাঁশের মোথা ও খেজুর গাছসহ জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য কাঠ। কিন্তু এ জ্বালানি কাঠ ব্যবহার না করে কীভাবে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে ইট পোড়ানো হবে তার নির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। আর জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করা হয় না এমন ইটের ভাটা আদৌ দেশে আছে কিনা সেটিও একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। আইনটির ধারা ৪(৫) মতে, আবাসিক এলাকা, বনাঞ্চল, ফলের বাগান, উপজেলা সদরের সীমানা, সিটি করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে কোনো ইটের ভাটা স্থাপন করা যাবে না। আবাসিক এলাকা মানে পঞ্চাশটি পরিবার বাস করে এমন এলাকা এবং ফলের বাগান মানে কমপক্ষে পঞ্চাশটি ফলদ বা বনজ গাছ আছে এমন বাগানকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের দেশে বাস্তবিকপক্ষে এমন শর্তে ইটের ভাটা স্থাপন করা সম্ভব নয়। কারণ আবাসিক এলাকা, বনাঞ্চল, ফলের বাগান, উপজেলা সদরের সীমানা, সিটি করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে জায়গা পাওয়া গেলেও সেখানে ইটের ভাটা স্থাপন করার মতো প্রয়োজনীয় সুবিধা পাওয়া যাবে কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশে প্রচলিত পরিবেশসংক্রান্ত অন্যান্য আইনের মতো এ আইনেও কোনো ব্যক্তির জন্য আদালতে সরাসরি অভিযোগ করার বা প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। আইনটির ধারা ৮(১) এ বলা আছে, জেলা প্রশাসক বা জেলা প্রশাসক কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা বন কর্মকর্তা বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, যাদের পদমর্যাদা সহকারী বন সংরক্ষক/সমপর্যায়ের নিচে নয় বা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এর লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোনো আদালত এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারের জন্য গ্রহণ করতে পারবেন না।
এত ঝামেলা, এত বিপরীত নিয়ম নিয়েও বহাল তবিয়তে টিকে আছে ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮৯ এবং এর অধীনে তৈরিকৃত ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ১৯৮৯। আর যে আইনের মধ্যেই এত ঝামেলাপূর্ণ বিপরীতধর্মী নিয়ম তার বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে সেটি সহজেই বোঝা যায়।