কার্টিস ডোয়েবলার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী। তিনি জেনেভার ওয়েবস্টার বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেনেভা স্কুল অফ ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের অধ্যাপক। জুরিস্ট ডট অর্গ থেকে তরজমা করা, ছাপা হয়েছিল যায়যায়দিনে।
যদিও পুরো ঘটনা এখনো স্পষ্ট নয়, তারপরও বেশিরভাগ প্রতিবেদনে এটা বোঝা গেছে যে, মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়েছে ন্যাটোর বিমান দ্বারা তার বহর আক্রান্ত হওয়ার পর (যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের বিমানও ছিল) এবং তাকে জীবিত আটক করার পর। যদি এসব ঘটনা সঠিক হয়, তবে এটা আরো সঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতায় আন্তর্জাতিক আইনের আরো একটা চরম লঙ্ঘন ঘটল।
সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ না নেয়া একজন যুদ্ধবন্দিকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করা ১৯৪৯ সালের থার্ড জেনেভা কনভেনশন অন দ্য প্রিজনারস অফ ওয়ারসের মারাতœক লঙ্ঘন। এ কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স দুটিই পক্ষরাষ্ট্র। নির্দিষ্ট যুদ্ধবন্দিকে কেউ অপছন্দ করুক বা না- তাতে কিছু যায় আসে না। এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত সব পক্ষের সর্বশেষ দায়বদ্ধতা হলো অপরাধের তদন্ত করা, অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা এবং শাস্তি দেয়া।
এটা সত্য, তৃতীয় জেনেভা করভেনশন মূলত আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় কার্যকর থাকে। লিবিয়ায় যে সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছে- ন্যাটো যোগদানের পর সেটা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এ আগ্রাসন হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনের ভিত্তিতে। যদিও তাতে কোনো পার্থক্য তৈরি হয় না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন যে কোনো আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের ওপর প্রয়োগ হবে, যদি সেটা অবৈধও হয়। যদি কোনো দেশীয় পক্ষ বিদেশি শক্তির সঙ্গে মৈত্রী করে এবং নিজ দেশীয় জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে- যেমনটা ন্যাটোর অধীনে লিবিয়ার বাহিনীরা যুদ্ধ করছে; দেশীয় বাহিনীর কাজের জন্য সেই বিদেশি শক্তিকে দায়ী করতে হলে দেশীয় বাহিনী বিদেশি শক্তির দ্বারা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে হবে।
গাদ্দাফি হত্যার সময় ঘটনা এমনটাই ছিল। যদিও পুরো স্পষ্ট প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি, বেশিরভাগ প্রতিবেদন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, গাদ্দাফির বহর প্রথমে আক্রান্ত হয়েছে বিদেশি বিমান শক্তি দ্বারা এরপর দেশীয় স্থল বাহিনী দ্বারা। আরো দেখা গেছে যে, গাদ্দাফি পালাচ্ছিলেন এবং সেই সময়ে তিনি লিবিয়ার সাধারণ জনতার জন্য কোনো হুমকি ছিলেন না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নেই কোনো সশস্ত্র সংঘর্ষ থেকে পলায়নপর ব্যক্তিকে নির্বিচারে হত্যা করার। অন্যভাবে এ অস্ত্রের শক্তির ব্যবহার হয়েছে লিবিয়ার রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ভৌগোলিক অখ-তার বিরুদ্ধে, বিশেষভাবে যখন ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বাহিনী স্পষ্টভাবে এ ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছে যে, তারা লিবিয়ায় নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করবে না।
কয়েক মাস ধরে চলমান এ ধরনের হামলা আগ্রাসনের মতো সন্ত্রাসী অপরাধের জন্ম দেয়। এ ধরনের হামলা, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি সাপেক্ষে হলেও (নিরাপত্তা পরিষদও আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা বাধ্য), অস্ত্রের শক্তি প্রয়োগ নিষিদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক আইনের একটি মৌলিক নীতির মারাত্মক লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও এখানে প্রযোজ্য। এ আইন যুদ্ধাবস্থা বা শান্তিবস্থা- উভয়ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ আইন সশস্ত্র সংঘাতের চেয়ে আরো উচ্চমাত্রা নির্ধারণ করে আইনানুগ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য আবশ্যকীয় আইনানুগ অস্ত্র ব্যবহারকেও সীমাবদ্ধ করে। এক্ষেত্রে পুরো সংঘর্ষ জুড়ে ন্যাটোর প্রথমে বিমান শক্তির ব্যবহার এবং পরে স্থল শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কাউকে হত্যা করা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারকে মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করে।
যদি আন্তর্জাতিক আইনকে শ্রদ্ধা করা হতো তবে হামলাকারী রাষ্ট্রগুলোকে আক্রান্ত দেশের অবস্থাকে আইন লঙ্ঘন শুরুর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হতো, সেটা এখন অসম্ভব- কারণ গাদ্দাফিকে ইতোমধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে। গাদ্দাফি হত্যাকান্ডের মাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে স্বল্পসময়ের জন্য একটা পঙ্গু বাহিনীর ওপর জয়ী হিসেবে ভাবতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক সম্পর্ক এবং প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো তাদের আন্তর্জাতিকভাবে কৃত ভুল কাজগুলোর ন্যায্যতা দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর এ লঙ্ঘনকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আইন লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্যান্য রাষ্ট্রের বেআইনি কাজের প্রতি আন্তর্জাতিক আইন বিধি-নিষেধ আরোপ করলেও এমন কিছু আইনানুগ পদক্ষেপ আছে যা গ্রহণে আন্তর্জাতিক আইন কোনো বাধা হবে না। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার মূল্যমান কমিয়ে দেয়া, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বর্জন করা অথবা আন্তর্জাতিক পরিম-লে যুক্তরাষ্ট্রকে স্রে অবিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে গণ্য করা- এর যেকোনো একটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নেতিবাচক ফলাফল আকারে দেখা দিতে পারে।
কয়েক মাস ধরে চলমান আগ্রাসনের সমাপ্তি ঘটল বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মাধ্যমে, যা অন্যান্য রাষ্ট্র এবং অরাষ্ট্র সত্তাকে এই বার্তা দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বা এর কোনো ন্যাটো মৈত্রী যাকে শত্রু মনে করে, তাকে অবশ্যই হত্যা করবে অথবা করাবে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের নীতি নয়, জঙ্গলের আইনের নীতি। সম্ভবত এ হত্যার মাধ্যমে মুয়াম্মার গাদ্দাফি জীবিত থাকার চেয়েও বেশি সময় তার শত্রুর মাঝে ঘুরে ফিরে আসবেন। তার শত্রুরা শুধু নিজেদেরই দোষারোপ করতে থাকবে।