শ্বশুর বাড়িতে নানান ধরণের আচার অনুষ্ঠানে শরিক হতে হয় জামাইকে। অনেক সময় বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিয়া জামাইর মহত্ব প্রকাশ করতে হয় শ্বশুরকে।
আজ যেতে হলো শ্বশুরের কলিগের বাসায়। তিনি আবার আত্মীয়ও হন বটে। শ্বশুরের বড় ভাইর মেজ ছেলের সঙ্গে বিবাহ হয়েছে কলিগের মেয়ের। বরিশাল শহরের একদিকে বৃষ্টিতে জমে থাকা পানির কাছাকাছি একখন্ড জমিনের ওপর তাদের বাসা। সেখানে আসলাম।
আরো বিবিধ লোকজন দাওয়াতপ্রাপ্ত হয়ে এসেছেন। মুরুব্বীরাও আছেন। কারো মুখে দাড়ি। তারা পরস্পর পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলেন। ব্যাপার হলো কেউ কারো নাম জিজ্ঞেস করলেন না। কিংবা যার বাড়িতে দাওয়াত তার সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা। এরপর সবাই চাপাচাপি করে বসে যেতে লাগলেন।
আলোচনা চলা উচিত। কেউ আসলে নিশ্চিত না কার কি বলা উচিত, অথবা কি টপিকে আলোচনা করে খাবার আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করা দরকার। তো নীরবতা ভেঙ্গে নিরাপদ এক টপিকে আলোচনা শুরু করলেন এক মুরুব্বী। আমি তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। আর টেনশন নাই। সভার নিষ্প্রাণ ভাব কেটে গেছে।
বরিশাল বলেই কিনা জানি না; আলোচনা শুরু হলো পীর সাহেবদের নিয়ে। আগের পীরেরা কিভাবে মহৎ ছিলেন, কিসব কারামতি তাদের ছিল, এসব নিয়ে চলতে থাকলো আলোচনা। সময়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেল বর্তমান পঁচে গলে শেষ হয়ে গেছে। অতীতকালের সবকিছুই শ্রেষ্ঠ ছিল। আমন্ত্রিত যুবকরাও দ্বিমত করতে পারলেন না।
শর্ষিনা, চরমোনাই, কয়েদ সাব হুজুর, চলাভাঙ্গার পীর ও তাদের জুরিসডিকশন নিয়ে কথা বার্তা হলো। অাধুনিক কেউ কেউ তাদের জৌলুসময় জীবন যাপন পদ্ধতিকে রাজা-রাজত্ব-যুবরাজদের সাথে তুলনায় আনলেন।
গুরুত্বপূর্ণরা মনে করলেন, এ টপিকে আলোচনা আগানো ঠিক হবে না। তারা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও খাদ্যে ভেজাল নিয়ে জমজমাট আলোচনায় সবাইকে শামিল করাতে সক্ষম হলেন।
একজন হঠাৎ করে কাশ্মীর প্রসঙ্গ এনে ঈমানী জজবা প্রকাশ করলেন। বেশিরভাগ তার জজবার প্রসংসা ও মোদীর মুন্ডুপাত করলেন। একজন প্যান্টের ভিতর শার্ট ইন করা ভদ্রলোক কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থার জন্য কাশ্মীরীদেরকেই দোষারোপ করে স্ট্রং মতামত রাখলেন।
ক্ষুধা পেটে মাথা গরম থাকে। আলোচনায় কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে পড়তে লাগলেন।
এরমধ্যে খাবার আসা শুরু। আমার স্বস্তি লাগলো। সবাই নড়েচড়ে বসতে লাগলো। কম জায়গাতেই সবাই ঠাসাঠাসি করে বসে আরামের ভাব করতে লাগলেন।
প্রথমে আসলো গরুর গোসত আর চালের রুটি। আমার সবচেয়ে ফেবারিট খাবার। কিন্তু চালের রুটি দেখেই আমার খটকা লাগলো। হাতে ধরে দেখলাম বড় বিপদ। বরিশালের চালের রুটিতো এত খারাপ হয় না। আয়োজক হাসতে হাসতে বললেন, “রুটি রাতেই বানিয়ে রাখাতো, একটু বোধহয় শক্ত হয়ে গেছে।” আহারে! এই রুটির কালার ছাড়া আর কিছুই ঠিক নাই। মারাত্মক শক্ত, মোটা দস্তার মতন, বিশ্রি। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো।
পরের আইটেম পোলাও, রোস্ট, চাষের ফোলানো কই মাছ ভাজি, একটা ভাজি, পেপে রান্না, আর কোরবানীর গোশত। একটা আইটেমও ভাল হয় নাই। বরিশালের কোন বাড়িতে এত খারাপ খাবার আমি জীবনেও খাই নাই। আল্লাহ মাফ করুক। আমার সন্দেহ তীব্রতর হলো যিনি রান্না করেছেন, তার বাড়ি বরিশাল নয়। আশ্চর্য ব্যাপার খাওয়া শুরুর পর আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই শোকে আক্রান্ত; কারো মুখে কথা নাই। কিছু্ই করার নাই; এত খারাপ খাবার নিয়া কথাবার্তা চালানো যায় না।
খাবারের মান নিয়া সবাই যখন হতাশাগ্রস্ত, তখন হঠাৎ একজনের মস্তকে খাবার উঠেছে, ভদ্রলোকের চোখ দিয়া পানি বের হচ্ছে টপাটপ। এ উপলক্ষে তার নাম জানা গেল “রানা”। মিস্টার রানাকে হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি খারাপ খাবার থেকে রক্ষা পেলেন এবং নিজের জীবন বঁাচাতে সক্ষম হলেন।
শেষে আসলো ফিরনি, এই আইটেমটা মোটামুটি চলে। আর আমন্ত্রিত অতিথিদের কেউ হয়তো হকের মিস্টি এনেছেন, সেটাই পরিবেশনার সবচেয়ে মজাদার আইটেম।
হকের মিস্টি উপলক্ষে আবার সবাই আলোচনায় মজে উঠলো। কেন বরিশালে হকের মিস্টি সেরা, এবং কিভাবে অন্যান্য ব্রান্ডগুলা দিন দিন মার্কেট হারাচ্ছে, এসব নিয়ে যুক্তিতর্ক পেশ করা হলো। আমিও হকের মিস্টি খেতে খেতে আলোচনায় সহমত হলাম।
ছোট রুমের খাটে, চেয়ারে, সোফায়, যে যেভাবে সম্ভব খাওয়া শেষ করলেও আসল কষ্ট শুরু হলো খাবার শেষ হবার পরে। যেহেতু খাবার শেষ করেই বিদায় নেয়া সম্ভব না, আত্মীয়তার সম্পর্কের নৈকট্টের কারণে কাউকে হয়তো আরো বেশি সময় থেকে যেতে হবে, সেহেতু খাটে গা এলিয়ে যারা দিতে পারবে, তারাই প্রিভিলেজড। আমি যেহেতু আগে থেকেই খাটে বসে ছিলাম, তাই একটা বালিশসমেত গা ঢেলিয়ে একটু আরাম পেলাম। উপস্থিত লোকজনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রিভিলেজড মনে করলাম।
জামাই হওয়ার নানান সুবিধার একটা উপভোগ করতে থাকলাম।
Leave a Reply