ঢাকা শহরকে মাঝখানে রেখে চক্রাকারে ঘুরে আসলাম। নদীপথে। বেরাইদ ঘাট থেকে যাত্রা শুরু এবং শেষ। বালু নদী দিয়ে শীতলক্ষ্যা হয়ে ধলেশ্বরীর বুক চিড়ে বুড়িগঙ্গা পারি দিয়ে তুরাগ নদী শেষ করে আবার বালু নদী। দেখেছি ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা। শহর, সুন্দর গ্রাম, প্রকৃতি, শিল্প এলাকা, বন্দর, কারখানা, জীবন, জীবিকা আর মানুষ। গুগল ম্যাপ বলছে ১১২ কিলোমিটার নদীযাত্রা। সবিমিলিয়ে অনন্য সুন্দর সফর। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ভিন্ন রকমের উপলদ্ধি।
[youtube https://www.youtube.com/watch?v=PuoL2teSygs&w=560&h=315]
মাদানী এভিনিউ দিয়ে সোজা ১০০ ফিটের রাস্তা বালু নদীর তীরে এসে যেখানে শেষ হয়, সেখানটাই বেরাইদ ঘাট। ছোট্ট নদীর তীরে মফস্বলের একটা ঘাট বলেই মনে হয়। ট্রলার আছে ঘাটে বাঁধা- কেউবা নদী পার হয়ে ওপারে যাচ্ছে, কেউবা অদূরের কোন স্থানে। অনেকে যেন বাজার-সদাই করতে ঘাটে ভিরছে, কাজ সেরে ফিরে যাচ্ছে। ৩ আগস্ট ২০১৮ শুক্রবার সকালে এই ঘাটে এসে ট্রলারে উঠলাম। তখনো নিলামে হাক-ডাক দিয়ে মাছ বেচা-কেনা হচ্ছে। আমরা সাড়ে সাতটায় ট্রলার ছেড়ে দিলাম। অনেক পথ ঘুরে এসে দিনের আলোতেই এখানে আবার নামার ইচ্ছা।
সুন্দর বালু নদী দিয়ে আমরা দক্ষিণে যেতে শুরু করলাম। নদীর দুই পাশ ঘেষে প্রকৃতি আছে। দৃষ্টিনন্দন। যতটা না সৌন্দর্যে চোখ আটকায়, তার চেয়ে বেশি চোখ আটকায় মাথা উচু করে থাকা বিশালাকার সাইনবোর্ড আর নামফলকে। সব নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প, সিটি। বিক্রি-বাট্টা শেষ। বালু নদী যত আগে শুকিয়ে মরে গিয়ে বালু চিকচিক করবে ততই ভালো। ঢাকার মধ্যে আর মানুষ ধরছে না, আবার ঢাকায় না থাকতে পারলে কিবা থাকলো জীবনে? তাই ঢাকা শহর আশে-পাশের নদী-বিল মারিয়ে সম্প্রসারিত হতেই থাকবে।
তো, বালু নদীর শান্ত জলের ওপর ভেসে ভেসে আমরা যেতে থাকলাম। নদী-তীরের জীবনের দেখা পেলাম। পানির মাঝখানে মাঝখানে একটু উচুতে বাড়ি-ঘর ছোট ছোট দ্বীপের মতন ভাসছে। নৌকা দিয়া এরা একে অপরের সঙ্গে কানেক্টেট। একটা মসজিদ পেলাম একা দ্বীপে বিচ্ছিন্ন। নৌকা ছাড়া যাওয়ার উপায় নাই। এখানের জীবনের সাথে হাওরের জীবনের অনেক মিল। হয়তো এখন পানির মরসুম বলে এমন, পানি শুকিয়ে গেলেই আরো ভরাট হতে থাকবে। আরো একটু মরবে নদী।
ডেমরার আগে একটা পল্টুন দেখলাম। লেখা আছে কায়েতপাড়া (ওয়াটারবাস ঘাট)। এই নদীপথে ওয়াটারবাস চালু হয়েছিল। রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে কাজে লাগিয়ে বৃত্তাকার নৌপথ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১০ সালে সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে এবং আশুলিয়া ও কাঁচপুরের মধ্যে বালু নদী ও টঙ্গী খালের ৪০ কিলোমিটার জলপথের সংস্কার করা হয়। নৌপথে নামানো হয় ওয়াটার বাস। কর্তৃপক্ষের নানা অব্যবস্থাপনা আর অবহেলায় ব্যর্থ প্রকল্পটির বর্তমান অবস্থা অজানা। আরো সামনে আগাতে জায়গায় নাম দেখলাম ধীৎপুর। আগে কখনো শুনি নাই। কত কিছু না জেনে শুনেই জীবন চলে যাচ্ছে দিব্যি!
দুই
বালু নদী আর শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলের ঠিক পরেই ডেমরা ব্রীজ। আরেকটু আগালে কাঁচপুর ব্রীজ। বহুবার এই সব ব্রীজের ওপর দিয়ে পার হওয়ার সময় ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকেছি। নিচের নদীতে ভেসে যাওয়ায় কোন জ্যাম নাই। এরপর ডানপাশে নায়ায়নগঞ্জ আর বাম পাশে বন্দর রেখে যেতে যেতে চোখে পড়ে অসংখ্য কল-কারখানা। জাহাজ, স্টিমার, কার্গো আরো কত কি! পুরোদস্তর ব্যস্ত আধুনিক। এইদিকে আর প্রাকৃতিক তেমন কিছু দেখার নাই। তবে যেতে যেতে দুইধারে যা দেখবেন, বুঝবেন, সে অভিজ্ঞতা অনন্য। এতসব কিছু দেখতে দেখতে আপনার জানতে ইচ্ছা করবে কিভাবে নারায়নগঞ্জ সারাদেশের অন্যান্য নদী ও সমুদ্রের সাথে কানেক্টেট, কত শত বছর ধরে কিভাবে সাপ্লাই চেইন মেইনটেন হয়ে আসছে।
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি-রাজনীতিতে শীতলক্ষ্যা নদীর এত এত গুরুত্ব ভাবতে ভাবতে হয়তো হঠাৎ করেই আপনার মনে ভেসে উঠবে অজানা ভয়। এই সেই শীতলক্ষ্যা যেখানে কিছুদিন পর পর লাশ হয়ে ভেসে ওঠে গুম-খুন-অপহরণের শিকার হওয়া আমাদের পরিচিত-অপরিচিতজন।
তিন
বালু নদীর চেয়ে শীতলক্ষ্যা বড় তার চেয়েও অনেক বড়, প্রশস্ত আর স্রোতস্বীনী হলো ধলেশ্বরী নদী। মুন্সীগঞ্জের কোনায় গিয়ে আমরা মিশে গেলাম ধরেশ্বরীর বুকে। এই নদী এই পথ আমার বেশ পরিচিত। বাড়ি থেকে আসার পথে লঞ্চ পৌছাতে কোনদিন খানিক দেরি হলেই সকালের আলোয় এই পথের দেখা পাই। আমরা ডানে মোড় নিয়ে এগোতে থাকলাম। বাম পাশে মুন্সীগঞ্জ শহর। ডানদিকে ইন্ডাস্ট্রি, বিশেষত সিমেন্টের। মুক্তারপুর ব্রীজ অনেক উঁচু কিন্তু প্রশস্ত বেশি না। চিকন। মনে পড়লো, এই ব্রীজের নিচে দিয়ে যাওয়া-আসা হয়েছে বেশি। ঠিক যেমনটা বুড়িগঙ্গার দু’টি ব্রীজ। বরিশাল অঞ্চলে বাড়ি হওয়া একটা ব্লেসিং।
দিনের বেলা হওয়ায় শুধুমাত্র চাঁদপুর রুটের কিছু লঞ্চের সাথে আমাদের দেখা হলো। আরো দেখা হলো জেলে, শ্রমিক, কার্গোসহ আরো কত জলযান। দেখলাম শত শত ইটের ভাটা। মনে পড়লো থার্ড ইয়ারে এনভায়নমেন্টাল ল’য়ে পড়েছিলাম, জনপদের তিন কিলোমিটারের (২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে বলা আছে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যেক এলাকা; সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর; সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি; কৃষি জমি; প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা; ডিগ্রেডেড এয়ার শেড (Degraded Air Shed)- এইসবের এক কিলোমিটারের) মধ্যে ইটের ভাটা স্থাপন বেআইনি। মনে মনে হাসলাম। ছাপার অক্ষরে আরো কত ভাল ভাল লেখা পড়েছিলাম, তাতে ঈমানও এনেছিলাম! এখনও দেখি, দেশের সব পেপার-ওয়ার্ক ঠিকঠাক আছে। কোথাও কোনো ঝামেলা নাই। গড়বড় নাই। কি সুন্দর! খালি বাস্তবতা আলাদা।
বুড়িগঙ্গায় ঢুকতে নদীর প্রশস্ততা কমে আসলো। ঢাকা নামক দানব শহর যে সামনে তার প্রস্তুতি বুঝা যায়। ফতুল্লা-পাগলা পার হয়ে জুরাইন। নদী তীর ঘেষে বড় বড় লঞ্চ, জাহাজ, কত কিছু। পুরো পথ জুড়ে একটা সুন্দর ওয়াক ওয়ে করা আছে। মনে পড়লো হাইকোর্ট বিভাগের একটা রায়ের আলোকে এই ওয়াক ওয়ে তৈয়ার করা। ঢাকার চারপাশের চারটি নদী বাঁচাতে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট বিভাগ ১২ দফা নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে ছিল নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সীমানায় পাকা খুঁটি বসানো, তীরে হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে) নির্মাণ ও বনায়ন করা, খনন করা, তীরের জমি জরিপ করা, যমুনার সঙ্গে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য নিয়মিত খননকাজ পরিচালনা করা প্রভৃতি।
আইন-আদালত একেবারে যে কাজে লাগেনা, তেমনটা না। ক্ষমতারে চ্যালেঞ্চ করেই তারে চলতে হয়। বেশিরভাগ সময়ই হেরে যায়। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একটা প্লাকার্ডে লেখা দেখলাম, “আইন একটা বাঁড়া, জায়গা মত শিথিল, বেজায়গায় খাঁড়া!”
চার
ঢাকার সদরঘাট সবার কাছেই পরিচিত। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ বিলাস বহুল লঞ্চ-জাহাজ চলে দক্ষিণে। তবে সাহিত্যে-সিনেমায় সদরঘাট বা এর সৌন্দর্যের উপস্থিতি কম। প্রচুর সিনেমায় কমলাপুর রেলস্টেশন দেখেছি, সদরঘাট কম দেখেছি। কিংবা দেখলেও পোটলা নিয়ে গরীব লোকেদের ঢাকায় আগমন দেখানো হয়েছে। আয়নাবাজি সিনেমায় বেশ কিছু দুর্দান্ত শট আছে, ড্রোনের।
এই সময়ে বুড়িগঙ্গার পানিতে দুষণ, বিশ্রি গন্ধ অনেকটাই নাই। অনেক শিশু-কিশোর-শ্রমিকদের দেখলাম দাপাদাপি করে গোসল করছে, সাঁতার কাটছে মনের সুখে। ভাল লাগলো। এই দৃশ্য অনেকদূর পর্যন্ত, বছিলা ব্রীজ পার হয়েও দেখলাম। এই পথে ঢাকার পাশে মূলত কল-কারখানা নাই। আছে ওপারে। দুই পার কানেক্টেড খেয়া নৌকা দিয়ে। নৌকায় পাটি বিছানো, লোকজন জুতা খুলে আরাম করে বসে নদী পার হয়। দেখতে বেশ লাগে।
পাঁচ
গাবতলী-আমিন বাজারের দিকে অসংখ্য ইটের ভাটা। আর বড় ট্রলার-কার্গো থেকে বালু-খোয়া-সুরকি-সিমেন্ট-কনক্রিট নামাচ্ছে শ্রমিকরা। এখনো যে শহর গড়া বাকি। অনেক কাজ। এই রুটে ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল। কত ভাল একটা উদ্যোগ ছিল। এখনো নানা গন্তব্যে কাছাকাছি মিরপুর পর্যন্ত ট্রলার চলে। আর নৌকায় পারাপার হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ।
মিরপুর দিয়াবাড়ি পার হতে হতে বিকেল শুরু হয়ে গেছে। নতুন একটা বিষয় নজরে আসলো। আমাদের মতন অনেক লোক দলবেধে ট্রলার ভাড়া করে ঘুরছে। তবে সেইটা নিরিবিলি নদী দেখা বা প্রকৃতি দেখা না। বিশাল সাইজের সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া করে যারপরনাই জোড়ে হিন্দি গান বাজানো। অনেকেই নিজেরা নাচে, বিরিয়ানী খায়, মজা করে। কোনো কোনো ট্রলারে দেখলাম ড্যান্সার আনা হইছে, হিন্দি বিটের তালে তারা নাচে, তাদের ঘিরে নাচে যুবকদল। একটা ট্রলারে দেখলাম হিজরা নাচতেছে। বুঝলাম এইটা নিয়মিত ঘটনা। ট্রেন্ড। এই শহরকে ঘিরে কত কিছুইতো হয়, কত কিছু অজানা।
ততক্ষণে আমরা তুরাগে। আশুলিয়া যাওয়ার যে রাস্তা, সেইখানে ব্রীজ খুবই নিচু। কেন এতো নিচু বানানো হয়েছে জানি না। বড় ট্রলার বা কার্গো আর যাওয়া উপায় নাই। আমাদের ট্রলারের উপরে বাশঁ বেধে সামিয়ানা টানানো ছিল। সেগুলে খুলে এগুতে হলো। আমরা খানিকটা সময় পেলাম। শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান নামা শুরু হয় এই বরাবর। অল্প সময়ে দেখলাম অনেক বিমান নামলো।
ছয়
টঙ্গী ব্রীজ পার হওয়ার আগেও আরো অনেক ডিজে পার্টি ট্রলারের দেখা পেলাম। আমাদের নিরীহ ট্রলার দেখা তাদের নাচানাচির মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু ব্রীজ পার হয়ে যা দেখলাম, তা আমাদের কারোরই দূরতম চিন্তাতেও ছিল না।
বাস চলাচলের জন্য টঙ্গী ব্রীজ তার একটু সামনে ট্রেন চলাচলের জন্য দুইটা রেলসেতু। রেলসেতু পার হওয়ার পর থেকে তুরাগ নদীর দুইধারে নদীঘেষে সুন্দর ওয়াক ওয়ে আছে অনেক দূর পর্যন্ত। দুই পাশের ওয়াকওয়েতে, নদীতীরের রাস্তায়, আশেপাশের অনেক স্থাপনায় দেখলাম হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করছে। প্রথমে মনে হলো যেহেতু শুক্রবার ছুটির দিন, তাই হয়তো শেষ বিকালটা কাটাতে নদীর তীরে এত এত মানুষ ভিড়। কিন্তু সবাই দাড়িয়ে-বসে আছে মুগ্ধ দর্শকের মতো। মনে হচ্ছে তুরাগ নদী একটা মাঠ, সেখানে খেলা হচ্ছে, আর উৎসুক-উৎফুল্ল দর্শক তা মজা নিয়ে দেখছে। আমাদের বুঝতে আরো কিছুটা সময় লাগলো। তুরাগের এখানটায় দেখা পেলাম আরো গন্ডায় গন্ডায় ডিজে পার্টির ট্রলার। তুরাগে ট্রলার ভাসিয়ে জোড়ে সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে বাজিয়ে উদ্দাম ড্যান্স দেয় একদল, আর নদীর দুই ধারে দাড়িয়ে মহাসমারোহে তা দেখে মজা নেয় হাজার হাজার লোক। ব্যাপারটা এরকম, একদল কিছু টাকা খরচ করে ট্রলারে আয়োজন করে মউজ করে, আর অগুনতি মানুষদল যারা কোনো কারণে ট্রলারে নাই, তারা মাগনা হা করে তাকিয়ে সেই ড্যান্স-মউজ দেখে। ডিজে পার্টির ট্রলারগুলোতে সুন্দর লাইটিং এর ব্যবস্থা আছে, তার মানে অনেক রাত পর্যন্ত এই পার্টি চলে। এটা নাকি বহুল প্রচলিত কালচার। নিয়মিত ঘটনা।
সাত
তুরাগে চলতে চলতে একসময় দুইপাশ থেকে উৎসুক জনতা দূরে মিলিয়ে যায়। শহর থেকেও দূরে সরে আসা হয়। এরপর শুরু হয় পুরো প্রাকৃতিক এক নদী। ততক্ষণে শেষ বিকাল, সন্ধ্যার আগ মুহুর্ত। তেরমুখ-রায়েরদিয়া ব্রীজের আগ পর্যন্ত যাত্রা অনেক বেশি ভালো লাগলো। এখনো পুরোপুরি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে চারপাশে। চোখ জুড়ানো দৃশ্য।
এরপরের তুরাগে প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন আছে, তেমনি আছে ভাল না লাগা দৃশ্যও। নদীর ঠিক তীরেই অনেক বাড়িঘর আছে, দেখে ভালো লাগবে। আবার যখন দেখবেন সেইসব বাড়ির লোকজন খোলা পায়খানায় সরাসরি নদীতে হাগু করে, তখন নিশ্চয়ই মেজাজটা খারাপ হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে রাত শুরু হয়ে গেছে। ৩০০ ফিটের দিকে যত আগাচ্ছি, অগুনতি ট্রলারের দেখা পাচ্ছি, যারা ডিজে পার্টির উদ্দাম ড্যান্সে ব্যস্ত। তুরাগ যেখানে বালু নদীতে মিশলো, তার কাছেই ইছাপুরা বাজার। এইখানে বেশ জমজমাট ঘাট আছে। ট্রলারে ডিজে পার্টির এইটা একটা স্টার্টিং পয়েন্ট।
বেরাইদ ঘাটে আমাদের ট্রলার থামলো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। পুরা ১২ ঘন্টা আমরা নদীতে চলেছি। মাঝখানে জুমার নামাজের জন্য ঘন্টাখানেক থেমেছিলাম। গুগল দেখালো ১১২ কিলোমিটার। সবকিছুই শেষ হয়। ঢাকাকে ঘিরে আমাদের নদীযাত্রাও শেষ হলো। হয়তো কয়েকবছর পর এইনদীগুলি মেরে ফেলা হবে। পরের প্রজন্মদের কাছে হয়তো আমাদের অভিজ্ঞতা টিকে থাকবে গল্প আকারে। তারা সন্দেহ-অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে।
শেষ করার আগে জানিয়ে যাই, ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। উদ্বেগজনক এই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন। গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর গড়ে দশটি নদী তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ইতিমধ্যে দখল ও দূষণের কারণে বিলীন হয়ে গেছে ২৫টি নদী। বর্তমানে বিপন্ন নদীর সংখ্যা ১৭৪টি।
খরবাখবর:
নতুন বাজার থেকে (ভাটারা থানা) সোজা রাস্তায় (১০০ ফিট) পূর্বে চলে গেলে বেরাইদ ঘাট। অটোরিক্সা/লেগুনা/রিক্সা পাওয়া যায়। বেরাইদ ঘাট থেকে ট্রলার পাওয়া যায়। আগে থেকে রিজার্ভ করে নিবেন। দরদাম করে নিবেন। ঢাকার চারপাশে পুরা নদীপথে ঘুরে আসার জন্য আমাদের কাছে প্রথমে চাইছিলো ৩০০০০/- টাকা। পরে দামাদামি করে ১২০০০/- টাকায় রাজি হইছিলেন। আর শেষে আরো ১৫০০/- টাকা বকশিস দিছিলাম। তবে এইটা অনেক কমে পেয়েছিলাম। শুক্রবার বা ছুটির দিন না হইলে ভাড়া কমানো যায়। আমরা যে ট্রলারে গেছিলাম তার নাম লুৎফর রহমান। খান পরিবহন মোবাইল ০১৯১৪৩৮১২৯১। আমরা ছিলাম ১০ জন। তবে ৩০ জন অনায়াসে যাওয়া যায়।
খাবারদাবার:
আমরা নিজেরা রান্নার আয়োজন করেছি। সব বাজার-সদাই করে ট্রলারে উঠেছি। সকালে ইলিশ খিচুড়ি, দুপুরে গুরুর গোস্ত, আলুভর্তা, সাদা ভাত, ইলিশ ভাজা আর দুইবেলা চা। একটা চুলা কিনে নিছিলাম, আর একটা সিলিন্ডার গ্যাস ভাড়া করছিলাম। পর্যাপ্ত খাবার পানি সাথে ছিল।
সতর্কতা:
এই ট্যুরে শারীরীক পরিশ্রম নাই। তবে দীর্ঘসময় বসে থাকার ক্লান্তি আছে। টয়লেট বাথরুমের ব্যবস্থা ভালো না। আমাদের সাথে মেয়ে সদস্য ছিল, যখন জুমার নামাজের জন্য আমরা থামছিলাম, তখন এক বাসায় গিয়ে তারা বাথরুম ব্যবহার করছে। দীর্ঘ যাত্রা তাই ভাল সফরসঙ্গী নির্বাচনে গুরুত্ব দিন। গল্প-আড্ডাবাজ বন্ধুদের নিয়ে যান। সাঁতার জানা না-জানা কোনো সমস্যা না। ট্যুর সম্পূর্ণ সেইফ। ট্রলারের উপরে সামিয়ানা টানানো ছিল, প্লাস্টিকের চেয়ার ছিল বসার জন্য। আমাদের ট্যুরের দিন সারাদিনই মোটামুটি মেঘলা আবহাওয়া ছিল। অন্যথায় বৃষ্টি বা রোদের অত্যধিক তাপ মোকাবেলা করা একটা চ্যালেঞ্জ।
প্লাস্টিক-পলিথিল বা অপচনশীন কোনো কিছু নদীতে ফেলবেন না প্লিজ। নদী প্রকৃতির দান, আল্লাহর রহমত। নদী হত্যা কইরা নিজের আর পরের প্রজন্মের ক্ষতি করবেন না।
Leave a Reply