মাম্পুর জন্য মায়া

মাম্পুর জন্য মায়া

মাম্পুর ভাল নাম জাহাঙ্গীর। মায়ের নাম জয়নব। জয়নব হুবাম্মা। মামার নাম ছোহরাপ মাঝি। বাপের নাম আমরা কেউ জানি না। তার বাপেরে আমরা কেউ দেখি নাই।

হুবাম্মা হইলো ফুফু আম্মার বিবর্তিত রূপ। ফুফু আম্মা থেকে ফুফাম্মা সেখান থেকে হুবাম্মা। জয়নব হুবাম্মার বিয়া হইছিল দক্ষিণের একটা গ্রামে। কি কারণে তার জানি ছাড়াছাড়ি হইয়া যায়। এরপর থেকে তিনি বাপের দেশেই থাকতে আরম্ভ করেন। জাহাঙ্গীর তার একমাত্র পোলা রইয়া যায়।

IMG_20160212_151019
মাম্পুর লগে হঠাৎ দেখা হইলো ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, শুক্রবার, লোহালিয়া তীরে। দক্ষিণ কান্দার গাজী বাড়িতে একটা মেজবানের দাওয়াত খাইয়া মাম্পু ফিরতেছিল। মেজবানে পাওয়া মিষ্টি কাগজে মুড়াইয়া মাম্পু তার মাইয়ার জন্য নিয়া যাইতেছিল। মাইয়া এখন হাপড় দেয়। মাম্পু এখন বোর্ড অফিস বাজারে একটা স-মিলের দোকানে কাম করে।

জয়নব হুবাম্মা কামে থাকতো আমাগো বাড়ি। হয় আমাগো ঘরে না হয় চাচামেয়াগো ঘরে। আমি বড় হইতে হইতে তারে চাচামেয়াগো ঘরেই থাকতে দেখছি বেশি। তবে মাঝে-মধ্যে ঘর লেপুনি বা অন্যান্য কাজে মায় তারে ডাকলে আমাগো ঘরেও কাম করতো। হুবাম্মায় গায়ে গোটা-গোটা অনেক বিচি ছিল। ছোটকালে তাই ডরাইতাম মনে হয়, কিন্তু তার আদরে-আন্তরিকতায় সবাই আমরা তার কোলে থাকতাম। আমি বড় হইয়াও দেখছি যে ছোট পোলাপান তার কোল থেকে নামতো না।

জাহাঙ্গীর আমার চাইতে বয়সে সামান্য বড় হইবে। প্রতিদিনই তার লগে খেলতাম। তারে চেতাইতাম। সে আছিল তোতলা। আবার কম বাড়ন্ত। একটা মজার জিনিস মনে করতাম তারে ছোটকালে। তারে চেতাইলে কারো কাছে নালিশ করতো না। তার তোতলামি, বোকা-বোকা কথা, কেমন জানি উচ্চারণ, বাকা চেহারা, কালো গায়ের রং—সবকিছু মিলাইয়া জাহাঙ্গীর ছিল একটা প্যাকেজ। সেই প্যাকেজের নাম হইয়া যায় ‘মাম্পু’। এর মানে কি আমরা জানতাম না। কেউ কেউ আবার তারে ‘জাঙ্কু’ ডাকতো। জাহাঙ্গীর নামে কেউ তারে চিনতো না।  জয়নব হুবাম্মারেও মাম্পুর মা নামে জানতাম।

তো মাম্পু বহুতদিন মর্জিনা আপাগো বাড়িতে কামে থাকছিল—মানে তারে সেইখানে কামে পাঠানো হইছিল; কয়েক বছর ছিল আরকি। তখন যখন আপাগো বাড়ি যাইতাম, আমারে তার সুখ-দুঃখের কথা কইতো। মনে হয় তখন থেকেই মাম্পুরে আমার আরো ভাল লাগা শুরু হয়, তার কষ্টরে অনুভব করতে পাইরা তার উপর মায়া তৈরি হয়। একদিন একটা কাঁচা কাঠাল গাছ থেকে পাইরা মাচায় রাইখা দিছিল, আমারে খাওয়াইবে কইরা, এক রাইতের মধ্যেই কাঠালটা নরম হয়ে খাওনের উপযোগী হইছিল। মাম্পু কইছিল ‘নাদু দিয়া পাকাইছি’।

এরপর সময় খুব দ্রুত কাটতে লাগলো। মাম্পু মর্জিনা আপাগো বাড়ি আর গেলো না। এলাকায় থাইকাই এবাড়ি-ওবাড়ি খুচড়া কামে থাকতে লাগলো। তাতে জয়নব হুবাম্মায় বিরক্ত, হতাশ। আর এলাকার পোলাপান-লোকজন মহাখুশি।


বহুদিন পর আবার সবাই মাম্পুরে খোচাইতে পাইরা মজায় থাকতে লাগলো। সমাজরে সুশীল বানাইতে গেলে কিছু একটাতো লাগে; হয় পাগল, নাইলে বলদ, নাইলে গোঙ্গা। এই টাইপের কিছু একটা না থাকলে সুশীল সমাজের বিনা খরচে বিনোদন কই? সুশীলতা বমি করনের পাত্র কই? সবাই মাম্পুরে সেই ‘রেডিমেইড প্যাকেজ’ ধইরা নিয়া নিজেরা কত ‘সভ্য-সুন্দরচেহার-উচ্চারণের-চালাক-উচ্চবর্ণের’ এইসব জাহির করতেই থাকলো।


বাজার-অনুষ্ঠান-মাহফিল-বিবাহ-খেলা-ইলেকশন সবকিছুতে মাম্পু অবধারিত হইয়া গেলো। সবাই সুখে থাকতে লাগলো। জয়নব হুবাম্মায় খালি কানতে থাকতো। কেউ কেউ বুদ্ধি দিয়া মাম্পুরে বিয়া করাইয়া দিলো। জয়নব হুবাম্মারতো নিজের ঘর নাই, তাই ভাই সোহরাপ মাঝির ঘরেই মাম্পুর বউ তোলা হইলো। বউ কয়দিন পর আর মাম্পুরে পাত্তা দিতে থাকলো না। ছোহরাপ মাছির ছোট পোলা খোকনের কাছে সে সুখের পাত্তা পাইতে লাগলো। মাম্পুর বউ বিদায় হইলো, খোকনেরে অন্য জায়গায় বিবাহ করানো হইলো। মাম্পুরে আবার বিবাহ করানোর আগে জয়নব হুবাম্মায় একটা ছোঠ ঘর উঠাইতে সক্ষম হইলো। এইঘরে মাম্পুর একটা মৃত বাচ্চা হইলো। তারপর এই বউও বিদায় হইলো।

171_8999
ফোল্ডার ঘাইটা জয়নব হুবাম্মার একটা ছবি পাওয়া গেছে।

এরপর মাম্পুরে ‘ভাল মাইয়া’ দেইখা বিবাহ দেওয়া হইলো। এখন মাম্পু কণ্যা সন্তানের জনক।

মাম্পু বিএনপির ডাই-হার্ড কর্মী। মাঝখানে আমারে একবার কইলো ইউনিয়ন কমিটিতে সে পোস্ট পাইছে। পোস্টের নাম কইতে পারে নাই।

জয়নব হুবাম্মায় কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। অসুখে ছিলেন, শেষে মাথায়ও সমস্যা হইছিল। মাম্পুর জন্য জয়নব হুবাম্মার জমানো কিছু টাকা, কয়েকটা কাপড় এখনও আমার মায়ের কাছে আলমারিতে আছে।

মাম্পু এখন কেমন আছে জানি না।

এই লেখার উদ্দেশ্য কি মাম্পুর প্রতি আমার মায়া, নাকি সমাজের প্রতি বিরক্তি, নাকি আমার প্রতি জয়নব হুবাম্মার প্রচন্ড ভালবাসা আর আদরের জবাব?

আমি জানি না।

Leave a Reply