২০০২ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের এক গ্রাম পরিষদের নির্দেশে গণধর্ষণের শিকার হন মুখতারান মাই। তার ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী মাস্তয় গোত্রের এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগেই তার বিরুদ্ধে দ- কার্যকর করা হয়। অথচ তখন তার ভাইয়ের বয়স ছিল ১২ বছর। এ ঘটনায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে মুখতারান পাকিস্তানের নারী অধিকারের জন্য কাজ করে আসছেন। ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল দেশটির সর্বোচ্চ আদালত পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের এক প্যানেল ওই মামলায় অভিযুক্ত ছয় ব্যক্তির মধ্যে একজন ছাড়া সবাইকে বেকসুর খালাস এবং তাদের মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে লাহোর হাইকোর্টও একই রায় দিয়েছিলেন।
মূল লেখা: ড. হায়দার শাহ ডেইলি টাইমস, পাকিস্তান থেকে তরজমা করা, ছাপা হয়েছিল যায়যায়দিনে।
যারা খুব সহজেই বিশ্বাস করতেন যে বিচার বিভাগই পাকিস্তানে একমাত্র আইনের শ্রেষ্ঠত্ব ফিরিয়ে আনতে পারে, তারা মুখতারান মাই মামলায় সুপ্রিমকোর্টের রায়ে হতাশ হয়েছেন। অভিযুক্তদের খালাস দেয়ায় আমি আরো অনেকের মতো বিচার বিভাগকে কটাক্ষ করছি না। যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করেই সুপ্রিমকোর্ট মামলার রায় দিয়েছেন। আমরা মামলার ফল দেখে হতাশ; তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া শুধু প্রচলিত মতামতের ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়াটাও একই ধরনের বিরক্তিকর হতো। এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, আদালতের রায় পাঞ্জাবের গ্রামের এক তুচ্ছ মহিলার পক্ষে যায়নি। যখন অভিযুক্তরা মুক্ত হয়ে হেঁটে বেড়ায় তখন পুরো পাকিস্তানি সমাজ এর আদর্শ ও মূল্যবোধ সহকারে এমন নগ্ন ও বিরক্তিকর অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পুরো নজর পড়ে।
আমার কাছে মুখতারান মাই মামলা ‘বিচারবিভ্রমে’র (miscarriage of justice) আরেকটি নমুনা। যেক্ষেত্রে ভুল করে অভিযুক্তকে সাজা দেয়া হয়, এ শব্দগুচ্ছ সাধারণত সেক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তবে উল্টো ক্ষেত্রেও এটার ব্যবহার হয়, যেমন যেক্ষেত্রে ভিকটিম ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে যায়। পাকিস্তানে এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে বিচারকের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা অন্যান্য চাপের কারণে বিচারবিভ্রম ঘটেছে।
সমাজে যখন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির তৈরি হয়, তখন আইন বিভাগকে ও বিদ্যমান ব্যবস্থাকে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হয়। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলো, তারা এর মোকাবেলা করল সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ আইন ও পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। পাকিস্তানের সামাজিক আদর্শ হচ্ছে গোত্রতান্ত্রিক এবং সামন্ততান্ত্রিক সময়ের; অথচ এখানকার আইন হয়েছে বৃটিশ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে। সামাজিক বাস্তবতা এবং আইনের এ দূরত্ব দূর করতে আইনপ্রণেতা বা আইনবিজ্ঞানী কারো কাছ থেকেই কোনো পদক্ষেপ আসেনি। পঞ্চায়েত এবং অন্যান্য গোত্রীয় ও সামন্ততান্ত্রিক বিচারব্যবস্থা সংবিধানকে লঙ্ঘন করে একই সঙ্গে সমান্তরালভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। সেগুলোকে হটাতে মুখের কথা ছাড়া আর কি-ই বা আমরা করেছি?
যেখানে আমরা সবাই অলসের মতো আত্মতুষ্টিতে বসে থাকি, যেখানে এমন প্রত্যাশা কেন করি যে আদালত একাই সামনে থেকে আমাদের সবার জন্য লড়ে যাবেন? আইনি কাঠামোকে মেনে নিয়ে মুখ বন্ধ করে থাকার একটা অভ্যাস আমাদের তৈরি হয়েছে, আর যখনই বিদ্যমান ব্যবস্থায় অপর্যাপ্ততা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তখনই আমরা একে দোষারোপ করা শুরু করি।
ইন্ডিয়ায় জেসিকা লাল হত্যা মামলায় সাক্ষ্যের অভাবে অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে যাওয়ার পর পুরো জাতি হতাশ হয়েছিল। এরপর সুশীল সমাজ আর সংবাদমাধ্যমের প্রচেষ্টায় বিশাল জনমত গঠন করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। মুখতারান মাই মামলা পাকিস্তানের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে ঢেলে সাজানোর একটা সুযোগ তৈরি করেছে। বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে আইন তৈরি, একটা সচেতন সমাজ, সক্ষম পুলিশ ব্যবস্থা এবং একটি স্বাধীন বিচার বিভাগÑ এ চারটি হচ্ছে একটা ভালো বিচার ব্যবস্থার স্তম্ভ।
বিখ্যাত ইন্ডিয়ান সিনেমা ‘দামিনি’তে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সানি দেওল। সিনেমায় তিনি ভাগ্যাহত যেসব নারী দুর্বল সাক্ষ্যভিত্তিক অপরাধ বিচারব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাত তাদের সাহায্য করতেন এবং উদ্ধার করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাস্তব দুনিয়ায় এমন কোনো নায়ক দেখা যায় না। তাই সমাজ যতদিন পর্যন্ত না নায়কোচিত ভূমিকায় রূপান্তরিত হয়ে ভাগ্যাহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে, ততদিন পর্যন্ত মুখতারান মাইদের অপেক্ষা করতেই হবে।