আমার ক্রিকেট টিমের দয়াল সিকদারের গল্প

আমার ক্রিকেট টিমের দয়াল সিকদারের গল্প

শৈশবে হাডুডু-ডাংগুলি-বৌছি-বোমবাস্টিং—কতসব গ্রামীণ খেলার ব্যস্ত থাকতাম! বড় হচ্ছিলাম, খেলার মধ্যে আস্তে আস্তে ক্রিকেট ঢুকে গেলো। অল্প সময়ের মধ্যেই সবাইকে বাদ দিয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। ক্রিকেট ক্রেজ। সেই ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে।

কাঠ দিয়া নিজেদের বানানো ব্যাট আর টেনিস বল দিয়া শুরু। তাল গাছের ডগাও মাঝে মাঝে ব্যাট হতো আমাদের। এরপর রাবার ডিউস বল, আরো পরে টেপ-টেনিস। ১৯৯৮ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রথম ব্যাট কিনলাম। এলাকায় সেইটাই ছিল প্রথম ‘কেনা ব্যাট’।


পোলাপান যখন নিয়ম-কানুনই বুঝতো না, তখন আমি ক্রিকেট ফিল্ডের সব জানি। কাভার-থার্ডম্যান-লংঅফ-সিলি মিডঅন; কেমনে ‘নো-বল’ হয়, রান আউট—সব কিছু। ২০০০ সালে এলাকায় প্রথম ক্রিকেট লীগ আয়োজিত হলো। আমি একটা টিম ধরলাম। সেই লীগে আমার আর খেলা হয় নাই। স্কোরার ছিলাম। ক্রেস্ট পেয়েছিলাম। পটুয়াখালীর মধ্যে সেই লীগ বিশাল নাম করেছিল।


এরপর আমরা অনেক গ্রামের লীগে খেলেছি। তবে সবচেয়ে বেশি খেলা হতো, দ্বিপক্ষীয় ম্যাচ। যাকে আমরা বলতাম ‘টিম ধরা’। উত্তর কান্দার সাথে দক্ষিণ কান্দা টিম ধরছে; মানে দুই দল একটা ম্যাচ খেলবে ঠিক করছে। তো, আমি যে দলের ক্যাপ্টেন ছিলাম, সেই দল সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছে দক্ষিণ কান্দা দলের সাথে। সেই দলে হোসেন নামে চমৎকার একটা ক্রিকেটার ছিল, মাঝে মাঝে পুরা টিমকেই আমরা ‘হোসেন কান্দা’ বলতাম।

আমার টিমে ১১ জন খেলোয়ার পাওয়াই কঠিন ছিল। তাই ৭ জন বা ৯ জনের ম্যাচও খেলতাম। এরমধ্যে আমিসহ ৪-৫জন একটু ভাল খেলতো, মানে তারা ব্যাটিং-বলিং সবই পারতো, আর বাকীরা কোনোটাই পারতো না কিন্তু ১১ জনের কোটা পুরনে দলে চান্স পেতো।

দলের সেরা খেলোয়াড় ছিল দয়াল সিকদার। আমার সমসাময়িক সময়ে যারা খেলতো তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছিল দয়াল। অল্প রান-আপে দুর্দান্ত গতিতে বল করতো। আমরা সাধরণত তার বল চোখে দেখতাম না। ইয়র্কার বল করতে পারতো নিখুঁত। মিরাকল টাইপের ব্যাপার ছিল, দয়াল যদি বলতো ‘এই বলে তোর স্টাম্প খাইছি’, সেই বলে ব্যাটসম্যান নিশ্চিত বোল্ড আউট হতো। দয়াল বিশাল বিশাল ছক্কা মারতো পারতো, কিন্তু ব্যাটিংয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারতা না।

দয়াল আমার বাড়ির ছেলে। আমার চেয়ে দুই-তিন বছরের বড় হবে। গ্যাদা চাচার অভাবের সংসার ছিল। সকালে এলাকায় ঘুরে ঘুরে গোয়ালের কাজ করতো, দুধ সংগ্রহ শেষে শান্তি দুয়ারীর মাধ্যমে পটুয়াখালী পাঠাতেন, মাঝে মাঝে নিজে যেতেন। এরপর দুপুর আর বিকাল নাগাদ মাছ ধরতে শুরু করতেন গভীর রাত পর্যন্ত। দয়াল ছিল তার শ্রমশক্তি। তাই তাকে খেলায় পাওয়া খুব কঠিন ছিল। সকালেতো ১০টার আগে দয়ালের গোয়ালে কাজ শেষ হতো না, আবার ৯ টার মধ্যে ম্যাচ শুরু না করলে রোদ উঠে যেতো। বিকালে দয়ালের আরো কাজ থাকতো। গ্যাদা চাচার কত যে মাইর দয়াল খেয়েছে ক্রিকেটের জন্য! দয়ালরে দলে না পেলে আমার মেজাজ খারাপ হতো, তাই তাকে ফুঁসলেছি অনেক। আবার দয়ালের মাইর খাওয়া দেখে নিজেরে কারণ ভেবে অনেক মন খারাপ করে রেখেছি।

দয়াল অভাবের চাপে আস্তে আস্তে পিষ্ট হয়ে গেলো। জেলে হিসাবে কাজের সুবিধার্থে পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে বিড়ি ধরলো, এরপর গাঁজা। শরীরের জোর কমতে থাকলো। কিছুদিন পর বিয়ে করল। বছর খানেক পর বউটারে তালাক দিলো। আবার বিয়ে করলো। গ্যাদা চাচা-চাচী এর মধ্যে মারা গেলো। দয়াল সংসারি হয়ে গেলো। এক ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা হলো।

IMG_6499
আমাদের বাড়ির উঠানে দুই বছর আগের দয়ালের ছবি। পিছনের কোনার ছোট ঘরটা তার। ঘরের সামনে থেকে তার বউ আর মেয়ে হেটে আসছে ছবি তোলার জন্য। দয়ালের বর্তমান চেহারা আরো কাহিল।

কৈশোরে আমার সবচেয়ে বড় আফসোস ছিল দয়ালের এই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, গাইডলাইন, সুযোগ আর অভাবের কারণে একজন অ্যাথলেটের বিকশিত না হওয়ার সাক্ষী হয়ে থাকা।

জাতীয় দলের ক্রিকেটার রুবেল হোসনকে দেখলেই আমার দয়ালের কথা মনে পরে। একই গায়ের রং। প্রায় একই টাইপের গ্রাম্য পরিবেশ। রুবেল উঠে আসতে পেরেছে। দয়াল পারেনি; চেষ্টাও করেনি। চেষ্টা করতে হয় জানতোও না।

দয়ালের প্রতিভার খবর জানতাম অধিনায়ক আমি। দয়ালের সম্ভাবনার গল্পও সাজাতাম কিশোর আমি। দয়ালের ক্রিকেট প্রতিভা ধ্বংশ হওয়ার চুপচাপ সাক্ষীও আমি। আর এখন দয়ালকে নিয়া স্মৃতিচারণ করে সুশীলতাও করি আমি।


আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ রাত একটায় (১৫ মে), বরিশাল শেরে বাংলা হাসপাতালে দয়াল সিকদার মারা গেছে। নাটোরে সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয় দয়াল, আরো কয়েকজনের সাথে। নাটোর হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসার পর দয়ার বাড়ি ফিরে এসেছিল। কিন্তু আহতাবস্থা থেকে ভাল হতে পারে নাই। দুমকী-পটুয়াখালী-বরিশাল হাসপাতাল ঘুরে তার মৃত্যু হয়। 


Leave a Reply