(২০১১ সালের জুনে যায়যায়দিনে ছাপা হয়েছিল)
মোবাইল কোর্ট অধ্যাদেশটি ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। ২০০৯ সালের এটি ৬ নাম্বার অধ্যাদেশ। অধ্যাদেশটি পরে জাতীয় সংসদে ২০০৯ সালের ৫৯ নাম্বার আইন হিসেবে পাস হয়। হরতালের সময় এ আইনটির প্রয়োগ করে শত শত লোককে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেয়া হয়। আইনটির সাংবিধানিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিতর্কিত এ আইনটি নিয়ে লিখেছেন জহিরুল ইসলাম মুসা
আইন আদালতের একটি মৌলিক নীতি হচ্ছে উভয়পক্ষকে শুনে যাচাই-বাচাই করে, সাক্ষী-প্রমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে রায় দেয়া। এ জন্যই অভিযোগ প্রমাণের জন্য সময়ের দরকার হয়, যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ এবং তাকে পছন্দসই আইনজীবী দ্বারা প্রতিনিধিত্বের সুযোগও আইনে দেয়া হয়েছে, যাতে তার সবধরনের অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা তিনি পান। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শিগগির গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং ওই ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ আইনি মর্যাদায় নাগরিকদের জন্য এটি একটি মৌলিক অধিকার।
কিন্তু আইন আদালতের আরো কিছু প্রতিষ্ঠিত নীতির লঙ্ঘন হয় অভিযুক্তকে তাৎক্ষণিকভাবেই বিচার করে শাস্তি দিলে। সংবিধানের সুরক্ষিত মৌলিক অধিকার এবং বিশ্বজনীন কিছু মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন হয় এমন বিচারিক প্রক্রিয়ায়।
সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল কোর্ট আইনের অধীনে তাৎক্ষণিক দ- আরোপের বিষয়টি নিয়ে আইনাঙ্গনে সমালোচনা হচ্ছে। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগ পৃথক হয়ে যাওয়ার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বিচার বিভাগের জন্য যেটি একটি আবশ্যকীয় পদক্ষেপ। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচার এবং তাৎক্ষণিক দ- আরোপের ক্ষমতা এখনো প্রয়োগ করতে পারেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। ভেজালবিরোধী অভিযান, ইভ টিজিং দমনসহ আরো কিছু ব্যাপারে আমরা ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক কাজে অংশ নিতে দেখি। ১২ ও ১৩ জুনের হরতালে এই প্রথম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের তাৎক্ষণিক বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের নজির আমরা দেখেছি।
মোবাইল কোর্টের ক্ষমতা সম্পর্কে আইনটির ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধারা ৫ এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১ এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করিবার সময় তফসিলে বর্ণিত আইনের অধীন কোনো অপরাধ, যাহা কেবল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তাহার সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হইয়া থাকিলে তিনি ওই অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করিয়া, এই আইনের নির্ধারিত দ- আরোপ করিতে পারিবেন।’
আইনটির তফসিলে মোট ৮৫ বিদ্যমান আইনের তালিকা রয়েছে। ১৮৬০ সালের দ-বিধির ৪৯ ধারা তফসিলে অন্তর্ভুক্ত আছে। এছাড়াও আছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ সহ আরো ছোট বড় ৮২টি আইন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, নির্বাহী বিভাগকে দেয়া বিচারিক ক্ষমতা এখনো অনেক বেশি প্রসারিত।
এ আইনের ৭ ধারার অধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গৃহীত হওয়ার পরপরই মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সংক্ষিপ্ত অভিযোগ লিখিতভাবে গঠন করে তা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠ ও ব্যাখ্যা করে শোনাবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি গঠিত অভিযোগ স্বীকার করেন কিনা তা জানতে চাইবেন এবং স্বীকার না করলে তিনি কেন স্বীকার করেন না তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চাইবেন।
অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ স্বীকার করলে তার স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করে তাতে অভিযুক্তের স্বাক্ষর বা টিপসই এবং দুজন উপস্থিত সাক্ষীর স্বাক্ষর বা টিপসই গ্রহণ করা হবে; এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার বিবেচনায় যথোপযুক্ত দ-ারোপ করে লিখিত আদেশ দেবেন এবং ওই আদেশে স্বাক্ষর করবেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্ত ব্যক্তির দেয়া ব্যাখ্যা সন্দেহজনক হলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেবেন।
আর অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা সন্দেহজনক প্রতীয়মান না হলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটি বিচারের জন্য উপযুক্ত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে প্রেরণ করবেন।
সংবিধানের ৩৫ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন।’ অনুচ্ছেদ ৩৫(৪) এ বলা হয়েছে, ‘কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।’ অথচ মোবাইল কোর্ট আইনের প্রয়োগকালে এ দু’টি বিধানই লঙ্ঘিত হওয়ার অনেক বেশি সম্ভাবনা থাকে।
মোবাইল কোর্ট আইনের ৮ ধারায় দ- আরোপের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ২ বছরের বেশি কোনো শাস্তি মোবাইল কোর্ট দিতে পারবেন না। এ আইনের অধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা চাইলে পুলিশ বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান অনুরূপ সহায়তা প্রদান করবে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারের সময় তল্লাশি, জব্দ এবং প্রয়োজনে জব্দকৃত পচনশীল বা বিপজ্জনক বস্তু বণ্টন করার ক্ষমতা রাখেন।
মোবাইল কোর্টের শাস্তির বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট। এবং তার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে দায়রা জজের নিকট।
গত ১২ ও ১৩ জুন হরতাল চলাকালে সারাদেশে তিন শতাধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, তাৎক্ষণিকভাবে বিচার করা হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকে। এছাড়া বর্তমান সরকার বিরোধী দল দমনে এই কোর্ট ব্যবহার করার যে রীতি চালু করল, পরবর্তী সরকারের দ্বারাও একই পথ অনুসরণের সম্ভাবনা থাকবে।
সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭ (২) অনুযায়ী, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসমঞ্জস, ততখানি বাতিল হইবে।’ ২৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র এই ভাগের (মৌলিক অধিকার) কোনো বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্য, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’
সংবিধানের অনেক বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হওয়া সত্ত্বেও মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এখনো বাতিল হয়ে যায়নি। আগামীতে হরতাল বা অন্যকোন ইস্যুতে এই আইনের প্রয়োগের সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দেয়া যায় না।
Leave a Reply