(২০১০ সালের লেখা)
আমাদের দেশের কোনো আইনেই ‘রাজনৈতিক মামলা’র সংজ্ঞায়ন করা নেই। অথচ আইন-আদালতের প্রতিটি বিষয়ের সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়ন দরকার সঠিক ব্যাখ্যা এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে। নতুবা আইনের বিষয়গুলোর অপব্যাখ্যা হতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে নানা জটিলতার। ফলে বিঘ্নিত হতে পারে ন্যায়বিচার। এজন্যই প্রতিটি আইনে এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ বিষয়গুলোকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংজ্ঞাহীন একটি আইনি বিষয়কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অথচ বর্তমান সরকার ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’-এ দোহাই দিয়ে সরকারদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অনেক মামলা এরইমধ্যে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং সমর্থক আমলাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা গত বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা ‘রাজনৈতিক মামলাগুলো’ পুনর্মূল্যায়নের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়, যার সভাপতি হচ্ছেন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করার সময়সীমা বেধে দেন। তিনবার বর্ধিত সময়সীমার শেষ তারিখ ছিল গত বছরের ১২ জুলাই। এ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৫৬৭৭ জন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও আমলা মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন।
সারাদেশে মামলা প্রত্যাহারের জন্য কয়েক হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ে। এরমধ্যে ৪৪৩৩টি মামলা মূল্যায়নের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি এ পর্যন্ত বৈঠক করেছে চৌদ্দবার। সর্বশেষ বৈঠক হয় ৯ মার্চ। বৈঠকে ১ হাজার ৭২টি মামলা নিয়ে আলোচনার পর কমিটি যাচাই-বাছাই করে দুর্নীতি দমন কমিশনের ছয়টিসহ মোট ৬৬৯টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। এ নিয়ে কমিটি এখনো পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৫৬২টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করলো। এর মধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদের দুটি মামলা রয়েছে। বাকি সব মামলা সরকার দলীয় নেতা, সমর্থক ব্যবসায়ী বা সাবেক আমলাদের। অনেক আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর মামলাও কমিটির বিবেচনার মধ্যে এসেছে। এগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ আলোচনাও হয়েছে, হচ্ছে। যেহেতু মামলাগুলো কোন মানদ-ের ভিত্তিতে প্রত্যাহার করা হচ্ছে সেটি স্পষ্ট নয়, তাই সেইসব আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় পাবলিক প্রসিকিউটরকে আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলা প্রত্যাহার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। খুব স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে সরকার এ ধারাকে অপব্যবহার করছে কি না? এরপর যে প্রশ্নটি জাগে সেটি হচ্ছে, কেন শুধু সরকারদলীয় নেতা বা সরকার সমর্থকদের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। যেহেতু এ সুবিধা শুধু কিছু ব্যক্তিরা পাচ্ছেন, তাই এর প্রয়োগ সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের আইনের চোখে সমান দেখার যে ঘোষণা সেটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় কি না তাও ভেবে দেখা দরকার।
মামলা যদি মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা বানোয়াট হয় আমাদের প্রচলিত আইনে আদালতের আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই তার জন্য সমাধানের পথ রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪১ক, ১৬৫গ, ১৪৫ এবং ২৬৫জ ধারায় বিধান আছে কিভাবে মিথ্যা বা বানোয়াট মামলা বাতিল হয়ে যায় রায় দেয়ার আগেই। আর মামলার রায় হয়ে গেলেও ধারা ২৫০-এর অধীনে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়াও দ-বিধির ২১১ ধারার অধীনেও রয়েছে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ। হাইকোর্ট বিভাগ তার নিজস্ব ক্ষমতাবলেও মামলা বাতিল করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেশ কয়েকটি মামলা এভাবে বাতিল হতে দেখা গেছে।
কোনগুলো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলা, কেনইবা এমন নাম দেয়া হয়েছে সেটির যেমন স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন দরকার তেমনি কোনো মানদ-ের ভিত্তিতে আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে এ মামলাগুলোকে প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে, সে বিষয়টিও খোলাশা করা দরকার। আর কেনইবা শুধু ক্ষমতাশীন দলের নেতা, সমর্থক সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে, সেটিও সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্য জবাব আসা দরকার। নতুবা যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাতে পরবর্তী সরকারগুলোও যে এমন প্রক্রিয়া থেকে সুবিধা নেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
Leave a Reply