বাংলাদেশের আইনপ্রণয়নের পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর সাহসী বক্তব্য

২০১০ সালের লেখা

বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আয়োজিত ‘সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক সহিংসতা : রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ শীর্ষক আলোচনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে সত্য এবং সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। সেই বক্তব্য গণমাধ্যমে কিছুটা বিকৃতভাবে এসেছে। আর তাতে চটেছেন আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম, যিনি নিজে একজন সংসদ সদস্য। এছাড়াও আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছন, যদিও তিনি নিজে একজন নির্বাচিত আইনপ্রণেতা নন। আইন প্রতিমন্ত্রী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরীর বিরূদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা দেন। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যাক্তির বিভক্ত এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগের বর্তমান বিচারক। তিনি আলোচনা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার, আইনপ্রণয়নে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা, রিমান্ড এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকার ও রাজনৈতিক দলের করণীয়, সংবাদ মাধ্যমের গুরুত্ব এবং সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। বিচারপতি চৌধুরীর পুরো বক্তব্যের সবগুলো বিষয়টি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; কোন খন্ডিত অংশকে বিকৃত করে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। অথচ সংবাদমাধ্যমে তাঁর বক্তব্যের খন্ডিত অংশের বিকৃত উপস্থাপন হয়েছে। এবং তা নিয়েই আইন প্রতিমন্ত্রী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলেও যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক এর এক বক্তব্যের পর আইনপ্রতিমন্ত্রী ঠান্ডা হয়ে যান। তিনি জানান, সত্য কথা বলার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে যাওয়া যায় না।
কিন্তু যেকারণে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর উপলদ্ধি এবং সাহসী বক্তব্য, সেই বাস্তবতাকে যেন সবাই স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছে। আমাদের আইন ব্যবস্থায়, আইনপ্রণয়ন পদ্ধতিতে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, সংসদীয় ব্যবস্থায় যে বাজে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটা সংস্কারের আকাঙ্খা বা উদ্যোগ কারো মাঝেই দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের আইনপ্রণয়নের পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং বিচারপতি চৌধুরীর সাহসী বক্তব্য:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন এর সংজ্ঞা হচ্ছে, আইন অর্থ কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতা সম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি। আর সংবিধান অনুযায়ী, আইন প্রণয়নের মূল ক্ষমতা সংসদের। এছাড়াও ৯৩ অনুচ্ছেদ এর অধীনে সংসদ ভেঙ্গে গেলে বা সংসদের অধিবেশনকাল ব্যতীত সময়ে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। তবে সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে অধ্যাদেশের সংসদ কর্তৃক অধ্যাদেশ অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সংসদে আনীত প্রত্যেকটি প্রস্তাব বিল বলা হয়। আর সংসদ কর্তৃক সেই আইন গৃহীত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলেই তা আইন হয়ে যায়। সংসদের আইন প্রণয়নের বিস্তারিত পদ্ধতি উল্লেখ আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি এর ১৩শ অধ্যায়-এ ধারা ৭২ থেকে ৯৮ পর্যন্ত।
সংসদে বেসরকারী সদস্যদের বিল এবং সরকারী বিল-এই দু’ধরনের বিল উপস্থাপন করা যায়। সরকারী বিলগুলো তৈরির কাজ শুরু হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিলের খসড়ার মাধ্যমে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় খসড়া বিলটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে নিরীক্ষার জন্য পাঠায়। এরপর আবার মন্ত্রণালয়ে তা ফেরত পাটানো হয়। সংসদে বিল উত্থাপনের পূর্বে সংসদের সচিবকে নোটিশ দিতে হয়। সচিব বিলটি সরকারী গেজেটে প্রকাশ করেন এবং বিলের উদ্দেশ্য এবং কারণ নির্দেশ করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন।
যে সংসদ সদস্য বিল উপস্থাপন করেন তিনি বিলের ব্যাপারে নিচের যে কোন প্রস্তাব করতে পারেন।
ক) সংসদ কর্তৃক বিলটি তাৎক্ষণিকভাবে অথবা প্রস্তাবে নির্দেশিত কোন ভবিষ্যৎ তারিখে বিবেচনার জন্য গহণ করা হোক, বা
খ) এটি কোন স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হোক, বা
গ) এটি কোন বাছাই কমিটিতে পাঠানো হোক, বা
ঘ) জনমত বাছাই করার জন্য বিলটিকে প্রচার করা হোক।

 

বাছাই/স্থায়ী কমিটির রিপোর্টের উপর বিতর্কের আওতাকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ধারা ৮১-এ বলা হয়েছে, ক্ষেত্রমত বাছাই কমিটি বা স্থায়ী কমিটির রিপোর্টের আকারে প্রদত্ত বিলটিকে বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হউক, এই মর্মে প্রস্তাবের উপর বিতর্ক কমিটির রিপোর্ট ও রিপোর্টের অন্তর্গত বিষয়াদি বিবেচনার মধ্যে কিংবা বিলের নীতির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন বিকল্প পরামর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিবে। এছাড়াও বিলটি যখন পাস করার জন্য সংসদে আনা হয় তখনও সীমিত পরিসরে বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। ধারা ৯১-এ বিতর্কের আওতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ক্ষেত্রমত বিলটি বা সংশোধিত আকারের বিলটি গ্রহণ করা হউক, এই মর্মের প্রস্তাবের উপর আলোচনা বিলটিকে গ্রহণের পক্ষে বা প্রত্যাখ্যানের পক্ষে যুক্তি প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিবে। বক্তৃতায় সদস্য তাঁহার যুক্তির জন্য যতখানি প্রয়োজন, তাহার অধিক বিলটির খুঁটিনাটি বিষয় উল্লেখ করিবেন না এবং তাহা সাধারণ ধরনের হইবে। এরপর সংসদে উপস্থিত সদস্যরা বিলটিতে ভোট দিবেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সংসদ সদস্য যদি তার দলের বিরুদ্ধে ভোটদান করেন অথবা সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদান থেকে বিরত থাকেন তবে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। সংসদে পাশ হওয়ার পর বিলটি রাষ্ট্রপতির কাছে সম্মতির জন্য পাঠানো হবে এবং তিনি ১৫ দিনের মধ্যে বিলটিতে সম্মতি দিবেন। এরপর সংসদের সচিব অবিলম্বে বিলটি সংসদের আইন হিসেবে বিলটি গেজেটে প্রকাশ করেন।

এখানে দেখা যাচ্ছে আমাদের আইনপ্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যে খসড়া তৈরি করে দেয় তার উপর পর্যাপ্ত বিতর্ক এবং আলোচনার সুযোগ নেই। আর একটি বড় বাধা হচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। এতসব সমস্যার সাথে আরো সমস্যা যোগ হয়েছে। সংসদ সদস্যদের অর্থাৎ যারা আইনপ্রণয়ন করেন তাদের আইনপণয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ জানাশোনা নেই। যার ফলে সংসদে বিতর্কের যে সুযোগ রয়েছে সেটাও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই উপলদ্ধি থেকেই বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী একটা কার্যকর এবং জনকল্যাণমুখী সংসদের আবশ্যকতা অনুধাবন করেছেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেছেন, “ডেমোক্রেটিক সোসাইটিতে বিশেষ করে পর্লামেন্টের সুবিধা যেখানে আছে। সেখানে এই পার্লামেন্ট, আইন সভা, এটা নতুন গাড়ি-বাড়ি কেনার জন্য না। মানুষের মঙ্গলের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন তারা। এখানে যারা যাবেন তারা আইন সম্পর্কে অবগত হয়ে যাবেন। আইন কিভাবে তৈরি হয়, কোন আইন মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে সেটা জানা দরকার। কাজেই একটা আইন প্রণয়ন করতে গেলে, সেটা পার্লামেন্টে এলে হু হু করে পাস করে দেবেন এ কাজটা হবে না। আইনটা পেশ করেন বিল আকারে, ড্রাফট সবসময় আসে এখানে সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে; ডিবেট করতে হবে। আর এই ডিবেটের মাধ্যমে দিনের পর দিন প্রয়োজন হলে মাসের পর মাস ডিবেট করে একটা আইন প্রস্তুত করতে হবে। এক সিটিংয়ে তিনটা আইন পাস করে দিলাম, এই আইন আমাদের জন্য কোন মঙ্গল হবে না, হচ্ছেও না। বাস্তবতা আমরা তাই দেখছি। সুতরাং পার্লামেন্টটাকে একটা সত্যিকারের পার্লামেন্ট তৈরি করতে হবে। সত্যিকারের পার্লামেন্ট হিসেবে এটাকে গড়ে উঠতে হবে।” বিচারপতি চৌধুরী দেশের বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছেন, “এমনও ঘটনা ঘটছে দেশে আইন তৈরি হয়েছে পার্লামেন্টের সব মেম্বার পড়েও দেখেনি সেটা কি। তারা আইনসভার সদস্য।”

টিআইরি’র রিপোর্ট অনযায়ী, ৯ম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের ১৯ কার্যদিবসে মোট কর্মঘন্টা ছিল ১৪৫ ঘন্টা ২২ মিনিট। আইনপ্রণয়ন কাজে মোট ব্যয় করা হয় মোট সময়ের মাত্র ৯.৭% সময়- মাত্র ১৪ ঘন্টা ৬ মিনিট। কিন্তু এরমধ্যেই পূর্বের সরকারের আমলে জারি কার ১২২ টি অধ্যাদেশের মধ্য থেকে ৩২টি আইন আকারে পাশ করা হয়।

বস্তুত বিচারপতি নজরুল ইষলাম চৌধূরীরর বক্তব্য আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আইন প্রণয়নে সংসদের কার্যকর ভূমিকার দৈন দশাকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এরপর তাঁর বক্তব্য নিয়ে আইনমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর বাজে প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিশোধপরায়ন আচরণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসুস্থতাকে আরো প্রকট করে তুলছে। এই অসুস্থতা, এই দৈন-দশা থেকে মুক্ত না হলে রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের সমন্বয় এবং স্বাভাবিক পথচলা ব্যহত হতেই থাকবে।

Leave a Reply