চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন তাঁর এক লেখায় বলেছেন,
মাথা উঁচু করে পথ হাঁটি। কিন্তু মাথা নত হয়ে যায় বিবেকের কাছে। সাংবাদিকতার নামে এ আমি কি করছি! এটা কি রীতিমতো একটা ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে না?
মানুষের দুর্ভোগ-দুর্গতি নিয়ে ব্যবসা। অনাহারী মানুষ আমার ব্যবসার পুঁজি। দুস্থ-দুঃখী মানুষ আমার সুনাম এবং অর্থ। তারাই স্বর্ণপদক, ফিলিপস পুরস্কার, আইডিই পুরস্কার, ইত্যাদি। এইতো কিছুদিন আগের কথা। গেছি শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে। সেখানে খাদ্যাভাবে মারা গেছে ৮ জন। আক্রান্ত দেড়শ। ছবি তুললাম যে-লোকটি ৭ দিন অনাহারে থাকবার পর আধসের চাল পেয়েছে আর আর তা-ই ৭ সদস্যের পরিবারটি ভাগ করে খেয়েছে, তার। ছবি তুললাম এক বৃদ্ধার যে নাকি খাদ্যাভাবে ভাত বা রুটির পরিবর্তে অনাহারী পেটে গতকাল খেয়েছে দু’টি কাঁচাকলা সেদ্ধ।
ঐ ছবি তুলে আনলাম। ঝিনাইগাতী থেকে শেরপুর, শেরপুর থেকে জামালপুর হয়ে ঢাকা। সংবাদে এসেই জমা দিলাম সচিত্র প্রতিবেদন। প্রতিবেদন পড়ে কনগ্রাচুলেট করলেন বেশ ক’জন পাঠক। বেশ ভালো হয়েছে লেখা। ছবি, সে তো আরো খুব ভালো। ‘থ্যাংক ইউ মোনাজাতউদ্দিন’।
ছবি ছাপা হয়। প্রশংসা যেমন পাই, তেমনি আবার ছবির বিল জমা দেই। বিল পাশ হয়ে যায় অল্প সময়েই। একেকটা ছবির জন্য পঞ্চাশ টাকা। একসাথে মোটা টাকা তুলি আমাদের হিসাব বিভাগ থেকে। দুপুরে খেতে যাই। শুভ্রায়, অথবা সংবাদ অফিসের নিচে মহুয়া রেস্তোরাঁয়।
খাই মুরগীর রান কিংবা খাসির কলিজা। কোনোদিন থাকে মাছ। থাকে গরুর ভুনা মাংস। গরম ভাত থেকে ধোঁয়ার সাথে সাথে উবে যায় সব স্মৃতি। অতীত উধাও, দুদিন আগে শেরপুরের কোনো অভাবী গ্রামে ছিলাম, ভুলে যাই। ভুলে যাই দীর্ঘদিন বেকার মজুর ভাদুর কথা, বিস্মৃতি হয় কাঁচাকলা সেদ্ধ-খাওয়া সেই বৃদ্ধা। যে-গ্রামে ক্ষুধা আজও আছে, যেখানে অনাহারজনিত অপুষ্টিতে মারা গেছে নরনারী শিশু, তারা কোথায়? কই? খাবারের টেবিলের ধারে ওদের ছবির টাকা আছে, ওদের নিয়ে লেখা ছবি-প্রতিবেদনের প্রশংসাবাক্য স্মরণ আছে, কিন্তু ধারে কাছে নেই আমার পণ্য। আমি যখন দুপুরে ভরপেট খাচ্ছি, তারাতো এই শহর থেকে অনেক দূরের গ্রামে আছে উপবাসী। তারা থাকুক কি মরুক, আধসের চালের ভাত ৭ জনে ভাগ করে খাক কিংবা কেউ খাক কাঁচাকলা সেদ্ধ, আমার যেন কিছু আসে যায় না! মানুষের কলিজাখাদক জনৈক খলিলুল্লাহ, অনেকদিন আগে ধরা পড়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে থেকে। সে খেত মৃত মানুষের কলিজা। খেত প্রকাশ্যে। আর আমি, অসম সমাজের আমি, সম্পদের সুষম বণ্টনহীন সমাজের আমি, জ্যান্ত মানুষের দুর্গতি-দুভাগ্য পণ্য করে খাই। এবং এই কাজটি করি কৌশলে, সবার চোখের আড়ালে, ফর্সা কাপড়ে দেহ ঢেকে। আমার মেকআপ খুব কড়া। ধরা যায় না।
( মোনাজাতউদ্দিন এর “পথ থেকে পথে” গ্রন্থ থেকে নেওয়া।
অপ্রকাশিত। ২২ ডিসেম্বর ‘৯০ )
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আমরা যারা গাজায় ইসরাইলের বর্বর হামলার নিন্দা জানাতে গাজার সাধারণ মানুষদের রার আবেদন জানিয়ে কিংবা ইসরাইলের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়া টি-শার্ট পরি। অথবা “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই”-জাতীয় শ্লোগান বুকে নিয়ে বেরাই। স্বাধীনতার পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে নানা কবিতা, গান বা কথামালা সমৃদ্ধ টি-শার্ট পরি, অথবা চে’র বা অন্যান্য আদর্শ পুরুষদের ছবি সমৃদ্ধ টি-শার্ট গায়ে দেই, এই আমাদের পুঁজি করে কেউ ব্যবসা করে না তো? আমাদের বিশ্বাসকে, আবেগকে, ভালোবাসাকে ইস্যু, কখনও কখনও বিজ্ঞাপন বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয় না তো কোম্পানীগুলো?
আর আমরা সরল বিশ্বাসে তাদের সহায়তা করছি না তো?
চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন খুব সহজ স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু এই ব্যবসায়িক কোম্পানীগুলো কি এটা কখোনো বলবে, মেনে নেবে?
Leave a Reply