সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করেছেন বদিউল আলম মজুমদারসহ কয়েকজন। সেই মামলায় ইন্টারভেনার হিসাবে যুক্ত হয়েছে বিএনপি, বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী, ইনসানিয়াত বিল্পব এবং চারজন আইনজীবী। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চে এই মামলার শুনানি হচ্ছে। আগ্রহের জায়গা থেকে বেশ কয়েকদিন শুনানি শুনেছি। সাংবিধানিক আইন ও জুরিজপ্রুডেন্সের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আমার বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
এক, পিটিশনারের আইনজীবী, ইন্টারভেনারদের আইনজীবী এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল—সবাই মোটামুটি একটা জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল ভিত্তির ওপর নিজেদের আর্গুমেন্ট সাজিয়েছেন। ‘বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন’। অষ্টম সংশোধনী মামলায় (১৯৮৯) বাংলাদেশে এই ডকট্রিন প্রতিষ্ঠা পায়, ইনডিয়ায় আরো আগে কেশভানন্দ ভারতী (১৯৭৩) মামলাসহ আরো কিছু মামলায় এই ডকট্রিনের প্রয়োগ হয়। যার মূল কথা হলো সংবিধানে এমন কিছু বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামো রয়েছে, যা পার্লামেন্ট চাইলেও সংবিধান সংশোধনের সকল প্রক্রিয়া মেনেও সংশোধন/পরিবর্তন করতে পারবে না।
দুই, বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন অষ্টম সংশোধনী মামলায় মেজরিটি জাজের অপিনিয়নে (৪-১) প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাস্টিস বদরুল হায়দার চৌধুরী মূল রায় দেন, জাস্টিস শাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আলাদা রিজনিং দিয়ে এগ্রি করেন। উল্লেখ্য, এই মামলায় ঠিক কয়টা/কোন-কোনটা আমাদের সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার তা কিন্তু ঐক্যমত হয় নাই। জাস্টিস এটিএম আফজাল ডিসেন্টিং জাজমেন্ট দিয়ে বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন প্রয়োগ হবে না বলে মনে করেন। জাস্টিস এটিএম আফজাল তাঁর ডিসেন্টিং জাজমেন্টে যে যুক্তি, তত্ত্ব এবং আইনি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেছেন, তা এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের আইনি ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল অগ্রগতি। আমার পুরোনো লেখা আছে, পড়তে পারেন।
তিন, এখন ব্যাপার হলো, এই বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিনের ওপর ভর করে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে চূড়ান্ত রকমের তাচ্ছিল্য দেখিয়ে এই ডকট্রিন ধ্বংশ করে দেয় পঞ্চদশ সংশোধনীর (২০১১) মাধ্যমে। সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ যোগ করা বলা হয়, ফ্যাসিবাদী সংবিধান বা এর কোন বিধান রদ, রহিত, বাতিল বা স্থগিত করলে বা উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে তাদের ফাঁসি হবে। আর অনুচ্ছেদ ৭খ নামে এটারনিটি ক্লজ যোগ করে ‘মৌলিক বিধানাবলী’ সংশোধন অযোগ্য করা হয়। যার মাধ্যমে আইন ও জুরিসপ্রুডেন্সের সাথে মশকরা করে আদতে বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিনকে মেরে ফেলা হয়। মোটাদাগে ফ্যাসিবাদী সকল বিধানকেই বেসিক স্ট্রাকচার বানিয়ে দেওয়া হয়, তার মানে সেগুলা কোনভাবেই কখনোই সংশোধন করা যাবে না।
চার, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া রিটের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেলারেল, মি. রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং মি. শিশির মনিরের সাবমিশন শুনেছি। তারা সবাই অষ্টম সংশোধনী মামলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বেসিক স্ট্রাকচারকে জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল ভিত্তি ধরেছেন। অর্থাৎ সবাই পিছনে ফিরে গিয়ে নিজেদের যুক্তির ভ্যালিডিটি নিচ্ছেন। এমন জিনিসের ওপর ভরসা করছেন যা অনুচ্ছেদ ৭খ এর মাধ্যমে আওয়ামী সরকার অলরেডি চুরমার করে দিয়েছে। ঠিক এই জায়গাটায় আমার আপত্তি, পিওরলি জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল জায়গা থেকে।
আমাদের কথা হলো, আওয়ামী লীগ অনুচ্ছেদ ৭খ এর মাধ্যমে বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিনকে যেভাবে ছ্যাড়াব্যাড়া করে দিয়েছে, সেটা অষ্টম সংশোধনীর রায়ের ওপর ভর করে ধুয়ে-মুছে প্রেজেন্টবল করা যাবে না।
ক্ষমতাশীন সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে কনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টের জুডিসিয়াল রিভিউ করার ব্যাপারে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আগ্রহ বা এ সংক্রান্ত নজির খুব একটা নাই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়া বদিউল আলম বা অন্যকেউ মামলাও করেন নাই। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চে এই মামলায় হয়তো শেষ পর্যন্ত পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে। সেই বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিনের ওপর সওয়ার হয়ে। এতে আমাদের জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল কোন অগ্রগতি হবে না। কনস্টিটিউশনাল জুরিসপ্রুডেন্স অনেক সামনে এগিয়ে গেছে। ইনডিয়াসহ অল্প কিছু দেশ এই ডকট্রিন গ্রহণ করেছে, আর কেউ গ্রহণই করে নাই।
মোদ্দাকথা হইলো, আওয়ামী লীগ সংবিধানকে এমন এক ল্যাবড়া-ছ্যাবড়া অবস্থায় নিয়ে গেছে, সেটা আর সংশোধনীর মোড়কে ঠিকঠাক করার সুযোগ নাই। এই কথা বুঝার পরও আমাদের বুড়া রাজনীতিবিদেরা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিতা’র আলাপ চালাচ্ছেন। আর পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়া মামলার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল, বিএনপির আইনজীবী, জামাতের আইনজীবী সবাই একই লাইনে সাবমিশন রাখছেন। পঞ্চদশ সংশোধনী (বিশেষত অনুচ্ছেদ ৭ক, ৭খ) বাতিল চেয়ে আবার কিছু কিছু জিনিস রেখে দিতে চাচ্ছেন!
এইযে কোর্টের ওপর ভরসা করে এভাবে জোড়াতালি দিয়ে সাংবিধানিক ক্ষত সারানোর চেষ্টা চলছে, সেটা কোন সুন্দর বা টেকসই পদ্ধতি না। আমাদের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এছাড়া মুক্তির কোন পথ নাই। কি পদ্ধতিতে সেটা হবে, গণপরিষদ কিভাবে গঠিত হবে, নতুন সংবিধানে কি থাকবে—এসব নিয়া আলাপ-আলোচনা-বিতর্ক চলুক। আমাদের সামনে আগানো দরকার।
Leave a Reply