সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে আমাদের অবস্থান

সংবিধান সংস্কারের জন্য গঠিত ড. শাহদীন মালিক কমিশনের কার্যপরিধি এবং অন্যান্য সদস্যদের নাম এখনো ঘোষণা করা হয় নাই। কিন্তু জুলাই-বিপ্লবের পর সংবিধান সম্পর্কে গণমাধ্যমে দেওয়া ড. মালিকের কিছু মতামত সংবিধান সম্পর্কে তার বোঝাপড়া এবং জুলাই-বিপ্লবের স্পিরিট তিনি কতটুকু ধারণ করতে পারছেন, সেবিষয়ে আমাদেরকে ক্রিটিকাল করে তুলেছে।

শুরুতে আমরা দেখে আসি মি. মালিক আসলে কি বলেছেন।

ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ঠিক পরের দিন, ৬ আগস্ট মি. মালিক দৈনিক প্রথম আলোতে কলাম লিখেন যার শিরোনাম “যেভাবেই হোক সাংবিধানিক কাঠামো দরকার“। একই তারিখে বিবিসি বাংলায় “বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে কীভাবে?”-শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যাতে উল্লেখ করা হয়, সংবিধানকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি বলা হয়ে থাকে। ফলে এটি না থাকলে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে নানান সমস্যা ও সংকট তৈরি হবে। এখন সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও প্রয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে কি? কোন উপায় কি আছে? সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, “উপায় অবশ্যই আছে, তবে সেটি করতে হলে বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই সরকার গঠনের চেষ্টা করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আইনজীবী মি. মালিক। এক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে যতজনকে পাওয়া যায়, তাদেরকে নিয়েই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। “সংবিধান রক্ষার স্বার্থে এটি নামমাত্র মন্ত্রিসভা হবে। তাদেরকে দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য উপদেষ্টামণ্ডলী রাখা হবে এবং তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করবেন,” বলছিলেন মি. মালিক।

কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী সে এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির আছে কী-না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। “বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, এককভাবে সংসদ বিলুপ্ত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নাই,” বলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি আরও বলেন, “সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহ্বান, সমাপ্তি এবং সংসদ বিলুপ্তি করবেন।”

৬ আগস্ট বিবিসি-কে দেওয়া শাহদীন মালিকের মন্তব্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের জন্য ‘সংবিধান রক্ষার স্বার্থে’ তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মধ্যে যতজনকে পাওয়া যায়, তাদেরকে নিয়েই নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। আবার তিনি এটাও জানালেন, এইটা ‘নামমাত্র মন্ত্রিসভা’ হবে। মূলত উপদেষ্টামণ্ডলী এই মন্ত্রীসভাকে দিক নির্দেশনা দিবেন। অর্থাৎ সাবেক আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা পুতুল বা রক্ত-মাংস-আবেগহীন হয়ে উপদেষ্টামন্ডলীর কথামত দেশ চালাবেন। আর এই পদ্ধতি রাখতে হবে ‘সংবিধান রক্ষার স্বার্থে’। আওয়ামী লীগের বিশ্রি ও উদ্ভট সংবিধানের প্রতি মি. মালিকের এই প্রেম আমাদেরকে শঙ্কিত করে তোলে, একইসাথে তার অনান্য বক্তব্য মিলিয়ে নিলে সংবিধান সম্পর্কে তার বোঝাপড়ার মাত্রাও স্পষ্ট হয়।

এছাড়াও গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বিবিসি বাংলা “সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন করে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্র ঠেকানো সম্ভব?”—শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে সংবিধান সংস্কারের পরিধি ও পদ্ধতি প্রশ্নে শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে যা যা দরকার তা বর্তমান সংবিধানেই আছে। বিদ্যমান সংবিধান দিয়েই চাইলেই সংকটের সমাধান সম্ভব”। সংবিধান বিশেষজ্ঞ মি. মালিক বলছেন, “বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ আছে। কোনটা সংস্কার করতে চায় কেন করতে চায় এই উত্তর কারও কাছে নেই। যে ধারাগুলো আছে সেটাতে আসলে অসুবিধা কোথায় সেটা তো জানা প্রয়োজন”।

তো, মি. মালিকের এই বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, বর্তমান সংবিধানে তার অগাধ আস্থা। এইটা দিয়েই ‘সংকট’ সমাধন সম্ভব। অর্থাৎ ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে তিনি এখনো একটি ‘সংকট’ আকারে দেখতে ও পাঠ করতে চাচ্ছেন। এইটা ভয়ংকর ব্যাপার। স্পষ্টত আমরা বুঝতে পারছি, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য ছাত্র-নাগরিকের বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করতে তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন।

আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সেখানে গাইডিং প্রিন্সিপাল হিসাবে ২০২৪ এর জুলাই-বিপ্লবের স্পিরিটের মেলবন্ধন হবে ১৯৭১ এর সাথে, ইতিহাস থেকে আমরা অনেক কিছু নিবো। কিন্তু সংবিধান নিয়ে যেসব হরর-অভিজ্ঞতা আমাদের দেখা হয়ে গেছে, সেখানে আমরা কোনভাবেই ফিরে যাবো না। 

নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে গণপরিষদ। আমরা আদালতের ওপরে ভর করবো না। উমুক সংশোধনী বাতিল করলে এই-সেই সুবিধা হবে—এসব কুতর্ক চলবে না। রাষ্ট্র কিভাবে চালবে, রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্ক নির্ধারিত হবে নিজেদের বানানো চুক্তি দিয়া। সেইটাই হবে আমাদের সংবিধান। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণ তা ঠিক করবে। আমাদের পুরোনো সংবিধানে এই সুযোগ নাই এবং সেখানে নাগরিক হিসাবে জনগণের গুরুত্বও নাই। জুলাই-বিপ্লব এই সুযোগ আমাদেরকে দিয়েছে। ছাত্র-জনতা আমাদের মুক্তি দিয়েছে।

Leave a Reply