শফিক মিয়ার রান্না এতই সুস্বাদু যে রান্না শেষ হওয়ার অল্প সময়রের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়; খাবার নিয়ে টানাটানি লেগে যায়। তাই “টানাটানি হোটেল” নাম দিয়েছেন এইখানে খেতে আসা লোকজন। হোটেল মালিক কাম হেড বাবুর্চি শফিক মিয়া এই হোটেলের কোনো নাম রাখেন নাই। নতুন কারো জন্য হোটেলটি খুঁজে পাওয়াও সহজ নয়। কোনো সাইনবোর্ড নাই। কোনো বিজ্ঞাপন নাই। আছে শুধুমাত্র এখানে অন্ততঃ একবার খাওয়া মানুষের মুখে লেগে থাকা স্বাদ—আর সেই মুখ থেকে অবলীলায় বের হওয়া তারিফ।
সেইরকম এক তারিফের সূত্রেই খোঁজ পেয়েছিলাম টানাটানি হোটেলের। বছর খানেক আগে। মৌলভীবাজারের এক ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। সেই দুপুরে খাওয়ার পর থেকে বাকীটা ইতিহাস। আমার জীবনে এখনো পর্যন্ত সেরা স্বাদের মাছ রান্না খেয়েছি এই টানাটানি হোটেলে।
হোটেলটা ‘এল শেইপে’র। চিপা। বসার ব্যবস্থা ভালো না। সামনে গেলেও বুঝা যায়না একটা খাবার দোকানে ঢুকছি। ভিতরে ঢুকে যাদের খাবার পরিবেশন করতে দেখবেন তাদেরও হয়তো পছন্দ হবে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, খাবারে কামড় বসানোর সাথে সাথে আপনি সবকিছু ভুলে হারিয়ে যাবেন অন্য কোথাও।
হোটেল মালিক এবং হেড বাবুর্চি নিজেই বাজার করেন। সব রান্না নিজেই করেন। এইটা তার নেশা। ভালো লাগে। প্রতিদিন সকালে বাজারে যান, বাজার ঘুরে অসাধারণ সব তাজা মাছ কিনে আনেন। কোনো চাষ করা মাছ তিনি কেনেন না। তিনি খুঁজে খুঁজে কেনেন তাজা মাছ। সেরা মাছ। নদীর মাছ, হাওড়ের মাছ। বিলের মাছ। বড় মাছ। দেশী মাছ। সেদিন জানালেন, একটা বড় বোয়াল কিনেছেন পাঁচ হাজার টাকায়। তেমনি মুরগী কিনেন দেশি মুরগী, যা গৃহস্থের ঘরে বেড়ে উঠেছে। সেই মুরগী কেনার জন্য ছুটে যান অন্য বাজারে, কিংবা গ্রামের ভিতরে। কিন্তু তার কোয়ালিটির ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ নাই। সোজা কথা।
শনিবারে সন্ধ্যায় খিচুড়ি রান্না করেছেন, কিন্তু গুরুর গোশত নাই সাথে। প্রশ্ন করার পর জানালেন, আজকে ভাল গরু জবাই হয় নাই। গোশত দেখে ভাল লাগে নাই, তাই কিনি নাই। ব্যস। কোয়ালিটি কন্ট্রোলে তিনি আপোষহীন। মসলা কিনতে যান ঢাকার মৌলভীবাজার, প্রতি তিন মাস পর পর।
সকালে নাস্তার আইটেম থাকে। আর মূল আয়োজন থাকে দুপুরে। রান্না করেন নিজের ইচ্ছামতো। পরিমান নির্ধারণ করেন নিজের ইচ্ছায়। দুপুরের রান্না করা খাবার শেষ হয়ে যায় দ্রুতই। রাতে খুব কম দিনই দুপুরের আইটেম পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে অন্য আইটেম বানান, কিন্তু ভাতের আইটেম না।
মৌলভীবাজারে আসলে এই হোটেল আমার জন্য রহমত। এত মজার খাবার। আল্লাহু আকবার। আল্লাহ শফিক মিয়ারে বেহেস্ত নসিব করুন।
শফিক মিয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। অনেকবার কথা হয়। কত কিছু নিয়া আলাপ করি। মুগ্ধ হই। ঈর্ষা হয়। তার কর্মপদ্ধতি আর জীবন দর্শন কত সহজ, সাধারণ। সবমিলিয়ে তিনি অনেক সুখী। তিনি বাজার করে, রান্না করে, কম দামে তা লোকজনকে খাইয়ে প্রশান্তি পান। তৃপ্তি পান।
৩৫ বছর তিনি ঢাকার অনেক নামকরা হোটেলের সাথে যুক্ত ছিলেন। এখনকার অনেক প্রতিষ্ঠিত হোটেলে তার শিষ্যরা চিফ শেফ। তিনি একসময় সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে চলে এসেছেন নিজ এলাকা মৌলভীবাজারে। বাড়ি থেকে হাটা দূরত্বে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন এই হোটেল, যাতে কাজ করেন তিনি, তার স্ত্রী তার দুই পুত্র সন্তান। আরেক পুত্র কাছেই আরেকটা গ্যারেজে কাজ করেন। সবাই একসাথে থাকেন, সুখে থাকেন। সুখের জন্যই অনেক মোহ ত্যাগ করেছেন, এখনো প্রতিনিয়ত অনেক লোভনীয় প্রস্তাব অনায়াসেই উপেক্ষা করেন।
চিন্তা করছিলাম, তার রান্নার যেই হাত, যেই কোয়ালিটি, যেই স্বাদ, এইসব নিয়া ঠিকঠাক মত মার্কেটিং করতে পারলে, বাংলাদেশের সেরা হোটেল হওয়া মোটেই কঠিন কিছু না। অনেক লোক এখনো তার সাথে পার্টনারশিপে আসতে চান। তিনি না করে দিয়েছেন। তাকে একলক্ষ টাকা বেতনের চাকুরীর অফার করা হয়েছে, তিনি প্রত্যাখান করে দিয়েছেন। তার বক্তব্য সোজা, আমি আমার ইচ্ছামতন কাজ করি। আমার যা ভালো লাগে করতে, তাই করি। সীমিত লাভ করি। কিন্তু মানুষকে এমন খাবার খাওয়াই যা তারা অন্য কোথাও খেতে পারবে না। পরিবারসহ একসাথে থাকি। আরামে থাকি।
শুক্রবার হোটেল বন্ধ রাখেন। নিজের বাড়ির কাম-কাজ করেন। রিল্যাক্স করেন।
জীবন দর্শনে আমিতো শফিক মিয়া হতে চেয়েছি। কিন্তু এখনো অনেক মোহ ত্যাগ করতে শিখি নাই।
[টানাটানি হোটেলে যেকোনো মাছের আইটেম হাইলি রিকমেন্ডেড। অসাধারণ স্বাদ। অমৃত। হোটেলটার অবস্থান মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল রোডে। ওয়াপডা রোড যেখানটায় এসে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল রোডে মিশে তেমাথা তৈরি করেছে তার থেকে একটু সামনে। কোনো সাইনবোর্ড পাবেন না। তবে অনেকগুলা মটর ওয়ার্কশপ আছে তার আশেপাশে। গুগল ম্যাপে টানাটানি হোটেল লিখে সার্চ করলে পাবেন। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করবেন। ‘ওয়ার্ড অফ মাউথ’ হোটেল টানাটানির একমাত্র সাইনবোর্ড এবং লোকেশন ইন্ডিকেটর।]
গুগল ম্যাপে টানাটানি হোটেলের অবস্থান
[googlemaps https://www.google.com/maps/embed?pb=!1m18!1m12!1m3!1d226.96725374948429!2d91.76541387862596!3d24.468956869454033!2m3!1f0!2f0!3f0!3m2!1i1024!2i768!4f13.1!3m3!1m2!1s0x375174885098ba5b%3A0xbe5f91705cba58cd!2z4Kaf4Ka-4Kao4Ka-4Kaf4Ka-4Kao4Ka_IOCmueCni-Cmn-Cnh-Cmsg!5e0!3m2!1sen!2sbd!4v1514956589650&w=400&h=300]
Leave a Reply