সুনামগঞ্জের সুনাম গাই

সুনামগঞ্জের সুনাম গাই

৭ নভেম্বর ফজরের ওয়াক্ত থাকতেই সুনামগঞ্জে নেমে দেখি বেশ ঠান্ডা। শীতের কাপড়তো আনি নাই। শরীর ঠান্ডা আর পেট গরম অবস্থা। কয়েকটা হোটেল তখন চুলা জ্বালাচ্ছে। একটায় দেখলাম পরাটা ভাজাও হচ্ছে। গিয়ে বসে পড়লাম। তাতে করে পেট ঠান্ডা আর শরীর গরম হলো।

খাওয়া শেষ করে সোজা নতুন ব্রীজ। প্রথম গন্তব্য বারেক টিলা। একমাত্র যানবাহন মটর সাইকেল। আর যাওয়া যায় পায়ে হেটে। চারজনের টিমের জন্য দুইটা মটর সাইকেল ঠিক করা হলো। ড্রাইভার দুইজন জ্যাকেট আর মাফলার গলায় দিয়া রেডি। আমি আর আমান একটায় উঠে বসলাম। কয়েক মাস আগে উদ্ধোধন হওয়া সুরমা নদীর ওপর ব্রীজটা অনেক উচুঁ। সুন্দর। ব্রীজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রাস্তার কৌদর্য শুরু। খারাপ আর খারাপ। রিস্কি। কোমড়ের হাড্ডি-গুড্ডি সব নড়েচড়ে আলাদা হয়ে গেল। ঠান্ডা বাতাসে কান শীতল হয়ে গেল। চিকন আর ভাঙ্গা রাস্তায় চলতেই থাকল মটর সাইকেল। পথে বিশ্বম্ভরপুরসহ আরো কত জায়গা ছাড়িয়ে গেলাম।


বিশাল বালুর মাঠ পেরিয়ে নদী। নদীর নাম যাদুকাটা। ওপারে বাকের টিলা। তার পরে ইন্ডিয়া। পাহাড়সব ইন্ডিয়ার। বালুর মাঠে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়েই মন ভাল হয়ে গেল। দূরে পাহাড়ের বড় বড় দেয়াল। তখনও কুয়াশাচ্ছন্ন। চারিদিকে মায়া ছড়িয়ে রেখেছে। নদীর তীরে নেমে দেখি কোমড়ের নড়ে-চড়ে যাওয়া হাড্ডি-গুড্ডি ঠিক হয়ে গেছে। যাদুকাটা নদীর যাদুতেই সম্ভবত। নদী পেরিয়ে বারেক টিলায় উঠলাম। হরেক রকম সৌন্দর্য চারিদিকে। পেছনে তাকালে কুয়াশসহ পাহাড়ের লম্বা দেয়াল। সামনে তাকালে যাদুকাটা নদী, তারপর বিস্তীর্ণ বালুর মাঠ, আরো দূরে আবছা পাহাড়ের দেয়াল। একটু দূরে নদীতে শত শত ট্রলার বালু তোলায় ব্যস্ত, টিলার ওপর থেকে দুর্দান্ত লাগছে। নাজমুল ভাই মনে করিয়ে দিলেন ‘ট্রয়’ মুভিতে যুদ্ধের নৌবহর তীরে ভেরানোর সেই দৃশ্যটার কথা।


11026267_10208356155086194_1611333229616071834_n
বারেক টিলার উপর থেকে তোলা বালুর ট্রলারের ছবি। ছবি: শাইখ মাহদী

সূর্য তেজ দিতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে, নতুন দুইটা মটর সাইকেলে আবার যাত্রা শুরু করলাম। গন্তব্য লাকমা। পুরো পথ পাহাড়ের কোল ঘেষে। পাহাড়গুলো ইন্ডিয়ার মেঘালয় রাজ্যের শেষ, আর পাহাড়ের পাদদেশ থেকেই বাংলাদেশ শুরু। রাস্তা খারাপ হলেও জার্নিটা তাই বেশ ভাল লেগেছে। পথে পেলাম টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প১৯৬৬ সালে স্থাপিত হয় বিসিআইসি’র এই প্রকল্প। আরো দেখলাম লাইমস্টোন লেক। লাকমাছড়া এক অনিন্দ্য সুন্দর জায়গা। দেখতে অনেকটা জাফলং বা বিছানাকান্দির মতো। মাহদী এইটার নাম দিল ‘‘বিছানাকান্দি/ জাফলং এর হারিয়ে যাওয়া বোন, যে একাকী থাকতে ভালোবাসে……..।’’ 

IMG_20151107_081229
বারেক টিলা, তারপর মোহময়ী যাদুকাটা নদী, এরপর বিস্তুৃত বালুর প্রান্তর, এরপর কুয়াশার কারণে পাহাড়ের আবছা দেয়াল।
জাফলং বা বিছানাকান্দি নয়, অনিন্দ্য সুন্দর এই জায়গার নাম লাকমা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় বাংলাদেশ আর মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী।
জাফলং বা বিছানাকান্দি নয়, অনিন্দ্য সুন্দর এই জায়গার নাম লাকমা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় বাংলাদেশ আর মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী। ছবি: আবদুল্লাহ আল আমান

এরপর ফিরে এলাম বড়ছড়া বা জয়বাংলা বাজারে। সেখানে গাভীর দুধের চা খেয়ে আবার রওয়ানা দিলাম শ্রীপুরের উদ্দেশ্য। পথে পেলাম পাটলাই নদী।

নদীর নাম পাটলাই।
নদীর নাম পাটলাই।

শ্রীপুর পর্যন্ত মটর সাইকেলে যাওয়া গেলো না। বেশ কিছু রাস্তা হাটতে হলো উঁচু-উঁচু জায়গায় বানানো মানুষের বাড়ির চিপা-চুপা দিয়া। শ্রীপুর বাজারের সবদিকেই হাওর। মাটিয়ান হাওর বামে ঘেষে। ডান দিকে কিছুদূর ঢুকলে টাংগুয়ার হাওর। তখন বেলা এগারটা। একটা ছোট সাইজের বজরা ভাড়া করে টাংগুয়ার হাওরে গেলাম। আহা। সে অন্যরকম সৌন্দর্য। যতদূর চোখ যায় পানি। শান্ত। ঢেউ নাই। আবার অনেক দূর পর উঁচু জায়গায় মানুষের বসতি, গ্রাম। হিজলের বন। তবে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাইতেও বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো এখানকার জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী জীবন-যাপন পদ্ধতি। তারপরও এরা অনেক সুখী।

টাংগুয়ার হাওর।
টাংগুয়ার হাওর।
হাওরের পানিতে গোসল করি। ছবি: আমান
হাওরের পানিতে গোসল করি। ছবি: আমান
টাংগুয়ার হাওরে হিজল বন।
টাংগুয়ার হাওরে হিজল বন।

হাওরের পানিতে নেমে গোসল করলাম। শ্রীপুরে ফিরে আসতে একটার বেশি বেজে গেল। শ্রীপুর থেকে আবার মাটিয়ান হাওরের বুক চিড়ে ট্রলারে করে যাত্রা করলাম তাহিরপুর। রক্তি নদীর তীরে তাহিরপুর উপজেলা।

রক্তি নদী। লামা বাজার পয়েন্ট, তাহিরপুর।
রক্তি নদী। লামা বাজার পয়েন্ট, তাহিরপুর। আমার তোলা ছবি।

বিকালে তাহিরপুর থেকে সিএনজিতে চলে আসলাম সুনামগঞ্জ। সন্ধ্যা হয়ে গেল। ঢাকায় ফেরার টিকেট কাটলাম রাতের গাড়ির। হাতে তখনও বেশ কিছু সময়। শহর ঘুরলাম। রিভার ভিউ নামে একটা জায়গা আছে, অথবা নতুন ব্রীজেও সময় কাটানো যায়। রাতের গাড়িতে ঢাকা রওয়ানা দিলাম। একদিনের সফরেই কভার হয়ে গেল সুনামগঞ্জ শহর, বারেক টিলা, যাদুকাটা নদী, টেকের‍ঘাট, লাগমা, পাটলাই নদী, শ্রীপুর, টাংগুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর, রক্তি নদী, তাহিরপুর।

সফর নিয়া শাইখ মাহদীর ফটো এ্যালবাম


 নোট

  • সুনামগঞ্জ নতুন ব্রীজ থেকে বারেক টিলা পর্যন্ত মটর সাইকেল প্রতি ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা। সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা।
  • বারেক টিলা থেকে লাকমা মটর সাইকেল প্রতি ভাড়া  ২০০ টাকা। সময় লাগে ঘণ্টাখানেক।
  • বড়ছড়া বাজার/লাকমা থেকে শ্রীপুর বাজার মটর সাইকেল প্রতি ভাড়া  ১৫০ টাকা। ঘন্টাখানেক সময় লাগে।
  • শ্রীপুর থেকে বজরা (নৌকা/ট্রলার) এর সাইজ এবং যত সময় ঘুরবেন সেই অনুযায়ী ভাড়া দরদাম করে নিতে হয়। আমরা ৭০০ টাকায় ভাড়া করেছিলাম।
  • শ্রীপুর থেকে তাহিরপুর লাইনের ট্রলারে গেলে ভাড়া ৩০ টাকা জনপ্রতি। রিজার্ভ গেলে দরদাম করে নিতে হয়। সময় লাগে এক ঘণ্টা।
  • তাহিরপুরে ভাল মানের খাবার হোটল নাই। মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া যায়।
  • তাহিরপুর থেকে মটর সাইকেল বা সিএনজিতে করে সুনামগঞ্জে আসা যায়। জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। সময় লাগে দুই ঘণ্টার বেশি। অর্ধেক রাস্তা ভাল, আর বাকী অর্ধেক খুবই খারাপ।
  • রাস্তাঘাটের অবস্থা আসলেই খারাপ। তাই মেয়ে সদস্য বা অসুস্থ লোকজন এইখানে যাওয়ার আগে রিস্ক বিবেচনা করে নিয়েন।
  • চারজনের টিমের সফরের জনপ্রতি খরচ পরেছে ১৯৭৭ টাকা।

Leave a Reply