ছোটকাল থেকে আমাগো ঘরে তিনটা রেডিও ব্যবহার হইতে দেখছি। বুঝতে শেখার পর থেকে দেখি তিন ব্যাটারির একটা রেডিও; লম্বা-চওড়া টাইপ, সুতলি দিয়া শক্ত কইরা বান্ধা। ধরতে ধরতে সুতলি কালা হইয়া গেছে। সবসময় এইটা চালু করন যাইতো না, কয়েকখান থাপ্পর লাগাইলে চলতো। আবার ঘ্যানর-ঘ্যানর করলে আবার থাপ্পর। এইভাবে থামতো আবার চলতো। ও.. চামড়ার একটা কভারও ছিল। তবে এই রেডিওটায় বিবিসি ধরতো না। আব্বায় বিবিসির খবর শুনতে উত্তর ঘরের জামাইর কাছে যাইতো।
কৈশোরে রেডিও শুনতাম। নিয়মিত।
আমার নিঃসঙ্গ সময়গুলোতে, অলস দুপুরগুলোতে, একাকী রাতগুলোতে সঙ্গী থাকতো রেডিও। বিকালে শুনতাম না, ক্রিকেট খেলতে যাইতাম। সেই ভয়জা রেডিও চালাইতে পারতাম আমি কায়দা কইরা। আর শুনতে পারতাম কত অনুষ্ঠান, গান, খেলার খবর। তবে শনিবার রাইত দশটায় নাটক হইতো। ছালু আর সেলু আপা মাঝে মাঝে শুনতে পারতো। আমি ঘুমাইয়া যাইতাম। একবার রাইত দশটা পর্যন্ত জাইগা থাইকা দুই টাকা পাইছিলাম।
সবচেয়ে বেশি শুনতাম রাত আটটা পাঁচের খেলার খবর। ঘড়ি সাথে না থাকলেও আটটা পাঁচ বাজলেই ক্যামনে ক্যামনে জানি টের পাইয়া যাইতাম। মজা লাগতো। সাড়ে সাতটায় ‘দুর্বার’ অনুষ্ঠান হইতো। কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান হইতো। কত কিছু হইতো।
অনুরোধের আসর ‘গানের ডালি’ হইতো। বিজ্ঞাপন তরঙ্গের অনুষ্ঠান হইতো। আর হইতো বিভিন্ন ‘সংগীতমালা’। ‘বেবি লজেন্স সংগীতমালা’ মনে হয় কয়েক হাজার পর্ব হইছিল। মাজহারুল ইসলামের কণ্ঠে সবচাইতে বেশি অনুষ্ঠান হইতো। এইলোক ধাঁধা দিতো গতানুগতিক। যেমর গান বাজাইয়া কইতো, শিল্পির নাম কি, ছায়াছবির নাম কি? লিখে পাঠান……….১২১ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ। কত মানুষ যে লিখতো।
আমার জাফর ভাইয়া লিখতো। ‘পটুয়াখালীর কাটপট্টি রোড থেকে জাফর আহমেদ’। সব অনুষ্ঠানে লিখতো না, নাজমুল হোসাইনের অনুষ্ঠানে লিখতো। আড়াই হাজারের রোমান মোল্লা, খুলনার খালিশপুরের সোহেল রানা—এইসব শ্রোতারা ছিল স্টার। নাজমুল হোসাইনের অনুষ্ঠান চমৎকার হইতো। ধাঁধা দিতো সেইরকম। যেমন ধরেন একবার ধাঁধা দিলো, একটা রেডিও আলমারির ওপরে রাখা, ব্যাটারি নাই। ব্যাটারি আছে আলমারির ভিতরে। কত কাছে, অথচ কত দূরে। এখন রেডিও কি গান গাইতে পারে! লিখে পাঠান।
আমারও মনে হইতো আমার নামডা যদি একবার রেডিওতে কইতো। জাফর ভাইয়া ব্যবস্থা কইরা দিছিলেন। একবার দুপুরের দিকে নাজমুল হোসাইনের কণ্ঠে শুনলাম পটুয়াখালীর মজুমদার হাট থেকে সালমা, সেলিনা আর জহিরুল। সারাটা বিকাল বুকটা আনন্দে ধরপর করছিল।
আমাগো ঘরের এরপরের রেডিওটা ছিল দুই ব্যাটারির। বিবিসি ধরতো। এন্টেনা খাড়া করলে টিভিও ধরতো। মনুর ঘরে টিভির ব্যাটারির চার্জ না থাকলে, বাড়ির কেউ কেউ সিনেমাও শুনতো!
২০০৪ এর মাঝামাঝিতে ঢাকা আসার পর থেকে আর রেডিও শোনা হইতো না। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে রেডিওর জন্য ‘কথিকা’ লিখতাম আর পাঠ করছিলাম কিছু দিন। মনু তার দোতলার জানালার উপরের দিকে ফিট করা বিশাল সাউন্ড বক্সে লাইন লাগাইয়া দিতো। বাড়ির সবাই শুনতো। আমি শুনতাম না। রেডিওতে কথা শুইনা একবার মিনুর মা’য় হেলালের মায়ের গলে কইলো, জহিরুলের বাপ-মায়ের আর লঞ্চে ভাড়া লইবে না।
এখন আর রেডিও শুনি না। হঠাৎ কইরা এফএমে আরজে গুলানের ভ্যাকর-ভ্যাকর কানে আইলে মনডায় কয় আমার পুরান রেডিওটার মত কষাইয়া কয়েকটা থাপ্পর লাগাই, তাইলে বুঝি আবার ঠিকঠাক কথা কওয়া শুরু করবে।
Leave a Reply