কিশোর বয়সে তিনটা প্রাণী আমি পালতাম। একটা গাভী, টিয়া আর নুসরাত।
গাভীটাকে ছোট দামড়ি বাছুর থেকে বড় করেছি- ঘাস কাটা, মাঠে (কোলায়) বান্ধা, খড়কুটা খাওয়ানো, গোসল করানো—সবই করেছি। পরে নিজের হাতে দুধ দোহন করেছি।
নুসরাতের জন্মের কয়েক ঘণ্টা পরে সেলিনা আপু মারা যায়। এরপর মা, ছালু, আমি আর আব্বা মিলে ওরে বড় করি। নুসরাতকেই দেখেছি একটা বাচ্চা কিভাবে আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। নুসরাত আমার সবচেয়ে আবেগের, ভালবাসার এবং দুর্বলতার জায়গা।
ছোট নুসরাতের কথা ফোটার আগেই কোত্থেকে যেনো একটা টিয়া আমি পেয়েছিলাম। পাতলা করে কাটা টিনের একটা খাঁচাও আমি জোগাড় করেছিলাম। ‘‘মিঠু’’ ছাড়া অন্য কিছু যে টিয়ার নাম হতে পারে, এইটা তখনো আমার মাথায় নাই (মীনা কার্টুনভক্ত হিসাবে)। তাই টিয়ার নাম রাখা হল ‘মিঠু’।
প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই আব্বা টিয়ার খাঁচাটা সামনের খোলা বারান্দায় কোণার দিকে একটা জায়গায় টানিয়ে রাখতেন। ফজর নামাজের পর পড়তে বসার আগেই খাঁচার কাছে গিয়ে ‘মিঠু’ বলে ডাক দিতাম। ক্যাচ ক্যাচ করে এক ধরণের শব্দ তৈরি করে সে জবাব দিত। ভাল লাগতো। নুসরাত ঘুম থেকে ওঠার পরপরই তারে নিয়া টিয়ার কাছে যেতে হোতো। সে ‘এত্তিয়াহ্’ ‘এত্তিয়াহ্’ টাইপের কিছু একটা বলতে শুরু করলো। টিয়া তার জবাবে আরো ক্যাচ ক্যাচ করে সারা বাড়ি আওয়াজে ভরিয়ে দিত। এইসব দেখে আমাদের সবার প্রশান্তি লাগতো।
তো, টিয়া অনেক দিন থাকতে লাগলো আমার সঙ্গে। আমার মনে হতে লাগলো, তার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ অন্য কোনো শব্দে রূপান্তিরত হচ্ছে—এই যেমন সে কড়া করে ‘মিতু’ ‘মিতু’ বলে নিজের নামের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করে। আমি সবাইকে জড়ো করি, বিশ্বাস করতে বাধ্য করি যে, টিয়া আর টিয়া নাই, সে ‘মিঠু’ হয়ে উঠায় চেষ্টায় ভালই আগাচ্ছে।
তার এই হয়ে উঠার প্রক্রিয়া এগোতে থাকলে নজর করলাম খাঁচাটায় জং ধরছে, তারও গায়ের লোম উঠা শুরু করেছে, শুকিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া কমে গেছে।
তার দিকে লম্বা সময় ধরে তাকিয়ে থাকতাম। সময় কাটাতাম। খাবার দিতাম। মাঝে মাঝে মনে হতো সে চাইলেও খেতে পারছে না, চোখে অসহায়ত্ব। টিয়ার প্রতি আমার মায়া আরো বাড়তে থাকলো।
শীত আসলে দেখলাম সে কাবু হয়ে যাচ্ছে। এক সুবহে সাদিকে আব্বা দেখলেন টিয়া মারা গেছে। এমন খাঁচায় তারে আটকিয়ে ছিলাম, এমন মায়ার তারে বেঁধে ছিলাম, না মরে সে আর মুক্তি পেতে পারল না। সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর।
সেলিনা আপু মারা যাওয়া ছাড়া এত বেশি চোখেল জল আমি আর কখনো ফেলতে পারি নাই।
Leave a Reply