২০০৯ সালের লেখা। কাঁচা হাতের। এখনো হাত পাকে নাই।
(১)
বেশ একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটেছে বাড়ির উঠোনের উত্তর দিকে। দশটার বেশি গৃহস্থ এবং তাদের সবার ভিন্ন ভিন্ন ঘরের বড় এই বাড়িটাতে অবশ্য এমনটা প্রায়ই লেগে থাকে। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ঝগড়া এবাড়িতে থেমে থেমে সচরাচর হয় । আর কোনো ঘটনা ঘটলে তো কথাই নেই। তবে এখনকার হুলস্থুলে সেখানে উপস্থিত সবার স্বরের সম্বনয় ঘটেছে। তাই সেখানে যে খুটিনাটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া লাগেনি সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। ঘর থেকে উঠোনে নামতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো আমার কাছে। পূবের ঘরের মাছুম গাছ থেকে পড়েছে। গাছ মানে বাড়ির উত্তর দিকের লম্বা গাব গাছটা, যেটাতে শয়তান আছে বলে ছোটদের ভয় দেখানো হয়।
‘আহারে গেছে পোলার পাওডা’ বলে চিৎকার দিচ্ছে রাহিমা। এতক্ষণে বাড়ির সবাই টের পেয়ে গেছে তার চিৎকারের কারণে। মাছুমের ডান পায়ের আঙ্গুল থেকে গোড়ালী পর্যন্ত ফুলে উঠেছে। ঠোঁটের নিচের দিকে কয়েকটা দাঁত বসে গেছে, রক্ত বের হচ্ছে। হাত সহ শরীরের আরো কয়েক জায়গার চামড়া উঠে গেছে। ‘ ওরে আমার পাওডা গেছে গেছে’ বলে চিৎকার করছে মাছুম। চেহারা হয়েছে শক্তিহীন পরাজিত জেদী সৈনিকের মত।
মাছুম যতটা না জেদী তার চেয়েও বেশি জেদী ওর বাবা রহিম সিকদার। ‘পারমু না ওরে ডাক্তার দেহাইতে’, ‘বহুত সহ্য করছি আর না’ ইত্যাদি আক্রোশপূর্ণ বাক্য বলে যাচ্ছেন একনাগারে। যখনই বুঝতে পারলেন আঘাত বেশ গুরুতর, নিজেই ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। পুত্রস্নেহের কাছে নিজের জেদ, রাগ, কষ্ট আবারো পরাজিত হলো। গ্রামের ডাক্তার যখন পা ভেঙ্গেছে বলে নিশ্চিত হলো তখন মাছুমের চেয়েও বেশি কষ্ট পেলো রহিম সিকদার। এইমুহুর্তে তার হাতে টাকা নেই সেটা যেমন কষ্টের কারণ তেমনি আগামী একমাসের বেশি সময়ের জন্য তার একমাত্র কাজে সাহায্যকারীর সাহায্য পাবে না সেটাও তো নিশ্চিত।
রহিম সিকদার আমার থেকে ৫০০ টাকা ধার নিল। যেই আমি অতিষ্ট হয়ে আগের অনেক টাকা ফেরত না পেয়ে ওকে আর টাকা দিব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, না করতে পারলাম না। মানুষের বিপদের সময়েই নাকি লোক চেনা যায়। আর এবাড়ি ও বাড়ি মিলিয়ে অনেক মানুষের সামনে এমন বিপদের সময় ধার দেয়ার মধ্যেও কিছুটা বড়ত্ব আছে। দয়ালু হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ারও সুযোগ আছে। সেটাইবা কেন হাতছাড়া করব!
(২)
বিকালে শহর থেকে মাছুমকে নিয়ে আসা হলো পায়ে মস্ত ব্যান্ডেজসহ। ৪০ দিন থাকতে হবে। ব্যাপারটা যে ডানপিঠে মাছুমের জন্য পুরোপুরি অসম্ভব তার প্রমাণ দিল সে কয়েকদিন পরেই। পায়ে ব্যান্ডেজ থাকায় যেহেতু পুরো গাছে ওঠা যাচ্ছে না তাই অর্ধেকটা উঠে লাঠি দিয়েই আম পারার কাজটা সে সাড়তে লাগলো নিয়মিতভাবে। ৪০ দিন পার হওয়ার আগেই সে নিজ উদ্যোগে নিজস্ব ছুড়ি দিয়ে ব্যান্ডেজ কেটে ফেলল। যদিও তখনও পা কিছুটা ফুলে ছিল। কিন্তু এভাবে অনেকটা গৃহবন্দী পরাধীন এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধ হয়ে দিনযাপন যে মাছুমের জন্য সম্ভব নয়।
রহিম সিকদার তাতে খুশিই হলেন। এতদিনে তাকে সাহায্য করার লোকের সংখ্যা বাড়লো বলে। অবশ্য এর আগে বড় ছেলে রফিক আবার বাড়ি ফিরেছে। ঢাকাতে ও যে কাজ করত, আবার ফিরে গেলে সেটা করা যাবে এমন একটা ব্যাবস্থা সে করে এসেছে। এসেই যোগ দিল নৌকার কাজে। নৌকার কাজ মানে সামনের লোহালিয়া নদীতে খেয়া পারাপারের ব্যাবস্থা করা। গত দু’বছর আগে যখন ওরা চর থেকে ফিরেছিল, তখন মোটামুটি কোনো ঝামেলা ছাড়াই খেয়া পারাপারের সুযোগটা রহিম সিকদার পেয়েছিল। কারণ তার নিজস্ব নৌকা ছিল। আর বাড়ির ঠিক সোজা ওপারেই সরকারি উদ্যোগে একটা গুচ্ছগ্রাম তৈরী হল। ব্যস, তাতেই সুযোগ তৈরী হলো খেয়া দেওয়ার আর ভাগ্য খুলল রহিম সিকদারের। নিয়মিত আয়ের একটা সহজ পথ তৈরী হলো। অবশ্য কাজীরা চেষ্টা করেছিল, রশিদ কাজীকে দিয়ে একটা খেয়া দেওয়াতে। কিন্তু সিকদাররা সেটা ম্যানেজ করেছে। আর রশিদ কাজীর শরীরের যা অবস্থা, তাছাড়া নৌকাও ছিল না তার। সেই থেকে আয়ও ভলো হচ্ছিল, এখনও হচ্ছে। এরই মধ্যে একমাত্র মেয়ে রুমার বিয়েটাও হয়ে গেছে। বড় একটা চিন্তা শেষ হয়েছে। কিন্তু ঋণের বোঝা ঠিকই বেড়েছে। কয়েকটা ব্যাংকের টাকা চড়া সুদে বেড়ে চলছে। চেনা-জানা মোটামুটি সবাই টাকা পাবে। সেসব বাদ দিয়ে বেশ একটা আয় হচ্ছে নৌকা থেকে। সাংসারিক খরচটা হয়ে যায়।
বাড়ি ফিরে রফিক নৌকার দায়িত্বটা নিল। মাছুম তাকে সহায়তা করতে লাগল। রহিম সিকদার সংসারের অন্যান্য ছোটখাটো কাজগুলো করতে লাগল। ইদানীং তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বহুদিনের পুরোনো মাজার ব্যাথাটা আবার বেড়েছে। বড় বা শক্ত কাজগুলো আর করতে পারছেন না। কিন্তু তারচেয়েও বড় যে সমস্যায় তিনি ভুগছেন তা হলো, মানসিক অবসাদগ্রস্ততা। পাশের ঘরের রাহিমা বা আউয়াল সিকদাররা যেটাকে ‘পাগলামি’ বলে। লোকজনের পাওনা টাকা না দেওয়ার একটা ফন্দি হিসেবে ইচ্ছে করেই রহিম সিকদার এমন পাগলামি পাগলামি ভাব করছে বলে তাদের ধারণা। এবং এই কথাগুলোর বহুল প্রচারের জন্য তাদের প্রচেষ্টা এবং তৎপরতা চোখে পরার মতো। কিন্তু পুরো জীবনেইতো মোটামুটি ব্যর্থ রহিম সিকদার। যতদিন গড়া জাল দিয়ে মাছ ধরতেন, চলে যেত সংসার। ধার দেনা বেড়ে যাওয়ায় একবার ঢাকা এসে কাজ করলেন কিছুদিন। ভাগ্য ফিরলনা। আর শেষমেষ যখন বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে নিয়ে ভাগ্য ফেরাতে সেই সুদূর চরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেটাকে পাগলামি ছাড়া আর কিছু আমাদের কাছে মনে হয়নি। তাই ঠিক আড়াই বছর পর আবার যখন রহিম সিকদারকে প্রায়শূণ্য হাতে ফিরে আসতে দেখলাম, আমরা অবাক হয়নি। আমাদের আশঙ্কা এবং ভবিষ্যৎবাণী সত্য হওয়ায় নিজেরা খুব উৎফুল্ল হলাম। রহিম সিকদারকে আরো বেশ বেশ উপদেশ দিতে লাগলাম।
(৩)
নিঃস রহিম সিকদারকে নতুন করে জীবন সংগ্রাম শুরু করতে হলো। নতুন করে ঘর বানাতে হলো। সবকিছুই নতুন করে শুরু হলো। নতুন নতুন উৎস থেকে ঋণ পাওয়া গেল। বেশ কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ নিল। এদিয়েই মেয়ের বিয়েটা এবং ঘর তৈরি হয়ে গেল। আর নৌকা থেকে আয়টা নিয়মিত-ই হচ্ছিল। এসব মিলিয়ে আবার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম চলছিল।
রফিক ঢাকা থেকে আসার সময় নগদ কিছু টাকা নিয়ে আসল। তাই দিয়ে নতুন একটা নৌকা কিনল সে। আগেরটার থেকে কিছুটা বড়। একটা মেশিন লাগিয়ে ট্রলার বানানোর পরিকল্পনা আছে। ট্রলারটা বানিয়ে শহরের সাথে সরাসরি একটা লাইন করতে পারলে আয় ভালই হবে। কারণ এই লাইনে এখন শহরের সাথে যোগাযোগের জন্য মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা লঞ্চ আছে। আর ধলাই মাঝির যে ট্রলারটা ঠিল সেটাও এখন বন্ধ। তাই সবকিছু মিলিয়ে ভাল একটা সুযোগ তেরি হয়েই আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, মেশিন লাগানোর জন্য যে নৌকাটা রফিক কিনেছে, সেটা খুবই ছোট। মেশিন লাগালে সর্বোচ্চ ১০-১২ উঠা যাবে। আর দ্বিতীয়টি হলো মেশিন কেনার মত টাকা এখন রফিক বা রহিম সিকদার কারো কাছেই নেই।
কিন্তু মেশিন যে কিনতেই হবে। রহিম সিকদারের ইচ্ছা রফিককে বিয়ে করানো। যাতে করে অন্যান্য জিনিসপত্র সহ মেশিন কেনার মত টাকা পাওয়া যায়। আর তা দিয়েই মেশিনের ব্যাবস্থা করা। কিন্তু এখন বিয়ে করতে রফিকের ঘোর আপত্তি। অবশ্য বিয়ে করতে পুরোটা নয়, বাবা-মায়ের পছন্দমত বিয়ে করতে তার আপত্তি। কারণ হলো, ঢাকাতে যেখানে সে ছিল, সেখানে একজনকে ভালবাসে। আর বিয়ে করতে হলে তাকেই করতে হবে। তাদের সম্পর্ক শুরুর কথা বা ওয়াদা ছিল এটা। সেটার উপর অবিচল থাকতে চায় রফিক। তাদের প্রেমকে অমরত্ব এবং পূর্ণতা দিতে চায়। যদিও রহিম সিকদারকে এখনও সে বিষয়টা বলতে পারেনি। একদিন আমার কাছে এসে বলল, ‘আপনি একটু আব্বারে বুঝাইয়া কন।’ আমি ভেবে পেলাম না আমি কেন রহিম সিকদারকে বুঝাতে যাব? আর কেনইবা তার মেশিন কেনার পরিকল্পনাকে বাতিল করে দেব? এখনও আমি ব্যাপারটা তাকে বলিনি।
রহিম সিকদারের ‘পাগলামি’ ধরা পরার পর থেকে নিয়মিত শ্বশুর বাড়িতে একজন নামকরা কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্ত্রী হামিদাকে নিয়ে তিনি সেখানে গেছেন গতকাল। মেয়ে রুমা শ্বশুর বাড়িতে। তাই বাড়িতে আজ শুধু রফিক আর মাছুম। গরু-বাছুর দেখার দায়িত্ব দেয়া হলো মাছুমকে আর নৌকার দায়িত্ব থাকলো রফিকের উপর। সাধারণত ওরা সন্ধার পরে নৌকায় কাউকে পার করেনা। আজ বিকালে একটা বরযাত্রী দল ওদের অনুরোধ করল, যেন একটু কষ্ট করে তাদরেকে রাতে পার করে দেওয়া হয়। অতিরিক্ত ভাড়ার বিনিময়ে রফিক রাজি হল।
রাত অন্ধকার। ছোট একটা অল্প আলোর লাইট ছাড়া আর কোনো আলো ছিল না। রফিকের গামছা দিয়ে বাধা অবস্থায় অল্পদামের মোবাইলটাও ছিল সাথে। আর বরযাত্রী দলের ছয়জন। মাছুমকেসহ মোট আটজন উঠল নৌকায়। ঢেউ ছিল। তবে এমনটা কখনও মনে হয়নি যে ডুবে যেতে পারে। বরযাত্রী দলের সবার সাথে মোবাইল ছিল। নগদ কিছু টাকাও ছিল। নৌকা যখন নদীর মাঝখানে, নৌকা ডুবতে যাচ্ছে এটা বোঝা গেল। প্রস্ততিও শুরু হল। রফিক মোবাইলটাকে নিজের কোমড়ের সাথে বেধে নিল। বরযাত্রীর সবাইকে যথাসম্ভব নির্দেশনা দিল। কিন্তু ঐ দলের বেশিরভাগই শহরের, সাঁতার জানে মোটামুটি। তবুও সবাই প্রস্তুতি নিল। বলে-কয়েই নৌকাটা ডুবল। ডুবতে থাকা নৌকাটা ছেড়ে সবাই সাঁতরাতে থাকল। আধাঘণ্টা পরে তীরেও পৌঁছানো গেল কোন ধরণের প্রাণহানি ছাড়াই। কিন্তু নদীর পানিতে মিশে গেল বরযাত্রীদলের চারটি মোবাইল, কয়েকহাজার নগদ টাকা, আর রফিকের স্বপ্ন। মেশিন লাগানোর স্বপ্ন। ট্রলার গড়ার স্বপ্ন। পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন।
নৌকাটা ডুবে যাওয়ার ঘটনাটা যখন রহিম সিকদার শুনবে, তখন কেমন করবে? তার পাগলামিটা বাড়বে, নাকি চুপ করে থাকবে, নাকি জোড়ে খুব জোড়ে চিৎকার করে কাঁদবে?
Leave a Reply