তুই বাদল কাজী, এখন অতীত। ১৬ এপ্রিল ভোরবেলা থেকে তুই অতীত হয়ে গেছিস সবাই জানল। যদিও তোর অতীত হওয়ার ঘটনা এই পৃথীবি জেনেছে রাতেই। রাতের নিস্তধ্বতাই তার একমাত্র সাক্ষী, রহস্যভেদী জানলেওয়ালা।
শামীম, আসাদ, সাহাদাত , তুই আর আমি মিলে সেই ছোট্টবেলা থেকে গাঢ় বন্ধুত্বটি গড়ে তুলেছিলাম। অলিখিত, অনানুষ্ঠানিক কিন্তু বাধ্যতামূলক কিছু নিয়ম ছিল আমাদের, যা তোর ভাল করেই জানা। নিয়মভাঙ্গার সবচেয়ে কম সম্ভাবনা ছিল তোর। অথচ তুই-ই কিনা সব বাধন সবার আগে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলি! বাদল, তুই কি এরজন্যে আমাদের বন্ধৃত্বের কাঠগড়ায় দাড়াবি না? তোকে আমরা প্রশ্নবানে জর্জরিত করব না? উত্তর দিতে না পারলে তোর দিকে আমরা রেগে-মেগে তেড়ে আসব না?
যেই তুই জীবনের খুব সহজ ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতি, সেই তোর হঠাৎ আত্নহত্যাটা আমাদের কাছে এক খটকা-রহস্যময় প্রশ্ন হয়েই থাকবে। মৃত্যুর একদিন আগে পহেলা বৈশাখের রাতে হিন্দুবাড়িতে নাটকটিতে তুই যে মেয়েটির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলি, নাটকে সেই মেয়েটি আত্নহত্যা করেছিল। সেখানে তোর আত্মহত্যা ছিল সবাইতে দেওয়া একটা ধোঁকা, ঘুনে ধরা সমাজের প্রতি একটা প্রতিবাদ। আর সেই তুই কিনা ঠিক একদিন পরে সেই একই ওড়না গলায় পেচিয়ে পুরো পৃথিবীকে ধোঁকা দিলি? আমাদের প্রচলিত সমাজের ঠিক কোন জিনিসটার প্রতিবাদ তুই করলি তাও আমদের কাছে অজানা রয়ে গেল!
গ্রামে রটেছে, হিন্দুবাড়িতে ঐদিন রাতে যে ভুতটা তোর সাথে এসেছিল, সে তোকে দিয়ে আত্নহত্যা করিয়েছে। তোর থেকে কয়েকশ মাইল দূরে বসে আমি এই পুরো বিষয়টার একটা মনস্তত্ত্বাত্তিক, বৈজ্ঞানিক এবং একাডেমিক ব্যাখ্যা খুঁজব। শামীম-সাহাদাতের কাছে তোর মৃত্যুর ব্যাখ্যা অন্যরকম হবে। কিন্তু যে আসাদের সাথে সেইরাতেও বড় একটা অংশ তুই আমাদের নিয়মিত আড্ডাস্থল লোহালিয়া নদীর তীরে কাটিয়েছিস, মন খুলে প্রাণবন্ত আড্ডা দিয়েছিস, প্রাণখুলে হেসেছিস-এর কয়েকঘন্টা পরে তোর আত্নহত্যার কোন ব্যাখ্যা কি ওর কাছে থাকতে পারে?
ক’দিন আগে গ্রামের একটি বেশ আলোচিত বিষয়ে আমরা যখন গুরুগম্ভীর আলোচনা করছিলাম-তুই সেখানে কত সহজ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলি, তোর মনে আছে? কত সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তুই হাস্যরস করতে পারতি! জীবনকে তুই খুব কাছ থেকে উপলদ্ধি করেছিলি বলে তোর চিন্তাগুলো সহজ ছিল, সরল ছিল। এই সরলীকরণ-ই কি তোকে আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল? আর তাই যদি না হবে, তাহলে এতবড় জীবনক্ষয়ী নষ্ট সিদ্ধান্তটা তুই নিতে পারতি না।
বাদল, আমার প্রশ্ন অনেক জটিল। কিন্তু আমি জানি সহজ করে উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তোর আছে। তোর অনেকগুলো স্বপ্নের একটি ছিল ছোটবোন নীপাকে সুখী করা। আত্নহত্যার সময় তুই নীপার ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়েছিস। তোর নীপা কি আর কখনও বিনা দ্বিধায় ওড়না পরতে পারবে? আমাদের বন্ধুরা যেসব জায়গায় আড্ডা দিই- লোহালিয়া নদীর তীর, মাদরাসার মাঠ, কলবাড়ি বাজার, রফিকের নৌকা-এসব জায়গায় কি আর আমরা যেতে পারব? আড্ডা শুরু করতে পারব, গভীর রাতে নীরব রাস্তায় হাটতে পারব? তুই এসে আমাদের সাথে যোগ দিবি না? আড্ডার শুরুতে এসে পিঠ চাপড়িয়ে বলবি না, ‘কি- খবর কি?’ আলোচনার মাঝখানে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য ‘ধুর…. বাদ দে’ বলে নতুন বিষয় নিয়ে আসবি না?
তোর সাথে আমার সর্বশেষ কথা হয়েছিল মোবাইলে, বেশ কিছুদিন আগে। তুই চলে যাবি সেদিন কেন আমকে বলিসনি। তোর থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতাম। আমকে না হয় না বললি, কিন্তু যে রাতে আত্নহত্যা করলি, তখনওতো অনেকক্ষণ আসাদের সাথে ছিলি। ওকে বলতিস, আমাদের পক্ষ থেকে তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিত। আর তখনও যদি তুই এই জীবনবিনাশী সিদ্ধান্তটা না নিয়ে থাকিস, তাহলে সেই গভীর রাতে যখন বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বেরিয়েছিলি, তখন চিৎকার করে কলতি, ‘এই পৃথীবি দেখো, আমি তোমাদের উপর অভিমান করে চলে যাচ্ছি’। রাতের নিস্তধ্বতা ভেঙ্গে সেই চিৎকার আমাদের কানে আসত। আমরা লজ্জিত হয়ে তোর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতাম। তোকে ফিরিয়ে আনতাম। কিন্তু কই সেই সুযোগতো আমাদের দিলি না!
শেষবারের মত আমরা, তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধুরা, এই সমাজ-সংসার, পৃথিবী, বাস্তবতাকে সাথে নিয়ে তোর কাছে মাফ চাইছি, ‘ক্ষমা করে দিস বাদল’।
Leave a Reply