বাংলালিংকের সৌজন্যে ঘুরে এসেছিলাম। আরো বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ছিল সঙ্গে। যায়যায়দিনে ছাপা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের শেষ দিকের এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ”শিলাইদহ ঘুরে এলুম। পদ্মা তাকে পরিত্যাগ করেছে, তাই মনে হল বীণা আছে তার নেই, তার না থাকুক অনেক কালের অনেক গানের স্নৃতি আছে। ভালো লাগলো, সেই সঙ্গে মনকে মন উদাস হলো।”
রবীন্দ্রনাথ-যুগের সেই পদ্মার গতিশীল পানি প্রবাহ এখন আর নেই। পানি গড়াই নদীতেও। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মও শেষ হয়েছে আরো অনেক আগে। কিন্তু শিলাইদহে আছে রবীন্দ্রনাথের নানা স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথের সেই স্মৃতিগুলোকেই জীবন্ত করে রাখতে চায় শিলাইদহের মানুষ। তাইতো প্রতিবছর তারা বেশ ঘটা করে পালন করে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।
রবীন্দ্রনাথের যুগে শিলাইদহ ছিল জমিদারী পরিচালনার জায়গা। ছিল রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী, যেখানে তিনি থাকতেন। তার বিশাল সৃষ্টিকর্মের বড় একটি অংশ সৃষ্টি হয়েছে শিলাইদহে। আর এখনকার শিলাইদহ কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি হয়ে তার কুঠিবাড়ীটি দাড়িয়ে আছে। আর এ নিয়েই এলকাবাসীদের যত গর্ব, আনন্দের উপলক্ষ।
গত ২৫ এবং ২৬ বৈশাখ কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিলাইদহে পালিত হয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৪৮তম জন্মবার্ষিকী। রবীন্দ্র স্মরণে ব্যস্ত ছিল সবাই। বসেছিল মেলা। শিলাইদহে ‘রবীন্দ্রমেলা’ হয়ে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। তবে ৭/৮ বছর আগে থেকে এই মেলা হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনের আয়োজনে। আর এবছরই প্রথমবারের মত আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে মোবাইল ফোন কোম্পানী বাংলালিংক।
হাজার হাজার দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিতে মেলার দু’দিনই ছিল সরগরম। রবীন্দ্রমেলাকে প্রণোচ্ছল এবং আনন্দময় করতে আয়োজকদের অন্তরিকতার ঘাটতি ছিলনা। দু’দিনের আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পুরোটা জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার মোট ৪০টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনা চলে গভীর রাত অবধি। এছাড়াও ভারতের শান্তি নিকেতন থেকে তিন সদস্যের একটি দল এসেছিল। তাদের একজনতো বলেই ফেললেন, রবীন্দ্রনাথকে স্মরণের ক্ষেত্রে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে শিলাইদহ।
২৫ এবং ২৬ বৈশাখ দু’দিনই দিনে প্রচন্ড গরম ছিল। তারপরও মেলায় উপস্থিতিতে কোন ভাটা পড়ে নি। তবে দিনে রোদের প্রখরতা থাকলেও রাত দু’টি ছিল চাদের আলোও মায়াবী। আর শেষ দিন অর্থাৎ ২৬ বৈশাখ ছিল র্পূর্ণিমা।
কবি রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেছিলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ হয়ে। ১৮৯১ সালে তিনি পতিসর-শিলাইদহ-শাহজাদপুরের জমিদারীর দায়িত্ব কাধে তুলে নেন। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৬ সালের ৮ আগস্ট একটি আমমোক্তারনামায় স্বাক্ষর করে তাকে জমিদারীর কর্তৃত্ব দেন। শিলাইদহে এসে কবি এর প্রেমে পড়ে যান। কবি শিলাইদহে মুগ্ধ হয়ে এক লেখায় লিখেছেন, ”বেলায় উঠে দেখলুম রোদ্দুর উঠেছে এবং শরতের পরিপূর্ণ নদীর জল তল তল থৈ থৈ করছে। নদীর জল ও তীর প্রায় সমতল, ধানের ক্ষেত সুন্দর সবুজ এবং গ্রামের গাছপালাগুলি বর্ষারসানে সতেজ ও নিবিড় হয়ে উঠেছে। এমন সুন্দর লাগল সে আর কি বলব। …… পৃথিবী যে কি আশ্চর্য সুন্দরী এবং কি প্রশস্ত প্রাণে এবং গভীরভাবে পরিপূর্ণ তা এইখানে না এলে মনে পড়ে না।”
শিলাইদহে এস কবি বিচিত্রতা খুজে পেয়েছিলেন। তাইতো এক লেখায় তিনি বলেছেন, ”পৃথিবী যে বাস্তবিক কি আশ্চর্য সুন্দরী কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।”
কবি রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব সৃষ্টিগুলোর মধ্যে সোনার তরী, চিত্রা, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, চোখের বালি, গোরা, চতুরঙ্গ, ঘরে বাইরে সহ আরো অনেক অসাধারণ সৃষ্টির সাক্ষী হয়ে আছে শিলাইদহ। এখানে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন ঘীতাঞ্জলীর অধিকাংশ গান। গীতাঞ্জলীর অনুবাদও শুরু করেছিলেন এখানে বসে।
শিলাইদহে কবির কুঠিবাড়ীতে কবির পরশ পাওয়া যায়। কবির ব্যবহার করা বিভিন্ন জিনিস, কবির নানা বয়সের ছবি যেন জীবন্ত রবীন্দ্রনাথকেই পাশে দাড় করিয়ে দেয়। তবে কুঠিবাড়ীতে যারয শুধুমাত্র কবি বা জমিদার রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যায়, তাদের কাছে কুঠিবাড়ী থেকে বেড়িয়ে এলে রবীন্দ্রনাথের আরও একটি বড় পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—শিল্পী রবীন্দ্রনাথ। শিল্পী রবীন্দ্রনাথের আঁকা অসাধারণ কিছু ছবি রয়েছে কুঠিবাঢ়ীল দেয়ালে। ছবিগুলো এমনি সুন্দর যে, সেগুলো দেখার পর যে কেউ কবি বেীন্দ্রনাথের চেয়ে শিল্পী রবীন্দ্রনাতকে বড় করে দেখতে শুরু করলেও দোষোর কিছু থাকবে না।
এবার রবীন্দ্রমেলায় শিলাইদহবাসীর একটি বড় প্রাণের দাবী জোড় গলায় উচ্চারিত হয়েছে– তা হল, দ্বিতীয় শান্তি নিকেতন। যারা সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে কুষ্টিয়াকে মনে করেন, এ দাবী তাদেরও। কলকাতার রবীন্দ্র স্মৃতিবিজরিত শান্তি নিকেতনের আদলে শিলাইদহেই হোক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়– দ্বিতীয় শান্তি নিকেতন।
শিলাইদহবাসী সরকারের কাছে আরো একটি দাবী জানিয়েছেন। ২০০৪ সালের শেষের দিকে প্রতœতত্ব অথিদপ্তরের পরামর্শক্রমে কুঠিবাড়ীর রং পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে সাদা রঙের কুঠিবাড়ীটি রবীন্দ্রনাথের আসল বাড়ীর রং বলে দাবী প্রতœতত্ব অধিদপ্তরের। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবী ঠিক উল্টোটা। তাদের দাবী, সাদা নয় আগের মেরুন রংই কুঠিবাঢ়ীর আসল রং। তাই সেই রঙেই ্বার বাড়িটিকে রঙিয়ে তোলা হোক।
সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহের জমিদারীর দায়িত্ব নেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ ছেড়ে যান। তবে শিলাইদহের স্মৃতিকে তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে মৃত্যুর বছরখানেক আগে শিলাইদহে নিখিল বঙ্গ-পল্লী সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল সেখানে রবীন্দ্রনাথ এক বাণীতে বলেছিলেন,’ ‘আমার যৌবনের ও পৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে। সেখানে আমার যাত্রাপথ আজ আর সহজগম্য নয়। কিন্তু সেই পল্লীর স্নিগ্ধ আমন্ত্রণ সরস হয়ে আছে আজও আমার নিভৃত স্মৃতিলোকে, সেই আমন্ত্রণের প্রত্যুত্তর অশ্রুতিগম্য করুণ ধ্বণিতেআজ্র আমার মনে গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছে।”
শিলাইদহের প্রতি এমন কৃতজ্ঞ কবিকে এখানকার মানুষ কি কখনও ভুলে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারে?
Leave a Reply