২৭ জুলাই ২০০৮ মুহসীন হলে ভূমিকম্পের পর লেখা

২৭ জুলাই ২০০৮ মুহসীন হলে ভূমিকম্পের পর লেখা

মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে বসবাস : সমাধান কার কাছে?

তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। মুহসীন হলে থাকি। ২৭ জুলাই ২০০৮। ভূমিকম্প হল। এরপর পত্রিকায় ছাপানোর জন্য লিখেছিলাম। কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এখন মনে নাই।

ভূমিকম্পের পরে মুহসীন হলের অবস্থা। ছবি: ডেইলি স্টার
ভূমিকম্পের পরে মুহসীন হলের অবস্থা। ছবি: ডেইলি স্টার

 

গত ২৭ জুলাই ভূমিকম্প হওয়ার পর থেকে রাত অথবা দিন কিংবা রাত এবং দিনের কোন অংশ-ই নিরাপদে কাটাতে পারছেনা ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা। প্রতি মূহুর্তে একটা ভীতি তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ভীতিটা অজানা কিছু নয়। পরিপূর্ণ জানা। এমনকি দূর্ঘটনা ঘটলে তার পরিণতি সম্পর্কেও সম্পূর্ণ অবগত শিক্ষার্থীরা। প্রশ্ন দাড়ায় কেন তাহলে এই ঝুকি নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। দূর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কেন তারা হলে থাকার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কেন তারা সম্ভাব্য ‘মৃত্যুপুরী’তে বসবাস করছে।একটি মারাত্নক দূর্ঘটনার খুব কাছ থেকে ফিরে এসেও কেন শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর অস্পষ্ট এবং অজানা।

ভূমিকম্পের পর শিক্ষার্থীরা নড়ে চড়ে বসেছে। হল কর্তৃপক্ষ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। সবাই সচেতনতার ভাব দেখাচ্ছে, অথচ এই মুহসীন হল কোন ধরণের ভূমিকম্প ছাড়াই যেকোন মূহুর্তে ধসে পড়তে পারত বা এখনও পারে। হলের বেশিরভাগ পিলার এবং প্রতিটি তলায় ভয়ংকর ফাটল কয়েকমাস আগেই দূর্ঘটনার বার্তা নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু সেই বাস্তব বার্তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোন প্রয়োজনীয়তাই দেখাননি হল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষার্থীরা। কেউ-ই সতর্ক হয়নি মুহসীন হলের সম্ভাব্য পরিণতি মোকাবেলা করতে। হল কর্তৃপক্ষ কয়েকটি লম্বা গজারী গাছ দিয়ে গুটিকয়েক পিলারের পাশে ঠেস লাগিয়ে সতর্ক হওয়ার একটা পদ্ধতি দেখিয়েছিলেন। ঐ পর্যন্তই। কয়েকমাস আগে প্রমাণিত হওয়া সেই মারাত্নক ঝুকি শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কাজে কোন বাধা হয়ে দাড়ায়নি। ফাটলগুলো বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করার পর ঝুকির পরিমান শিক্ষার্থীদের জানানো হয়নি। হয়তোবা কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জানানোর কোন প্রয়োজনই মনে করেননি। হল প্রভোস্ট বা হাউজ টিউটরগণ প্রয়োজন মনে করেননি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করার। সবাইকে ডেকে সতর্ক করে দেওয়ার কিংবা পরম মমতায় শিক্ষার্থীদের সাথে ঝুকির সম্ভাব্যতা নিয়ে মত-বিনিময়ের কাজকে কর্তৃপক্ষ হয়তো তাদের কাজের অংশ হিসেবে ধরে নেননি বা ধরে নিলেও পালন করেননি।

মারাত্নক ঝুকি সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা নিজেরাও সতর্ক হয়নি। অনেক শিক্ষার্থী টিউশনী বা ব্যাবসা এবং বান্ধবীর পিছনে সময় দেওয়ার পর এ বিষয়ে ভাবার সময় পায়নি। পলিটিকাল লিডারেরা তো আরো ব্যস্ত। নিয়মিত মিছিল-মিটিং এবং গেস্টরুমে সময় দেওয়ার পর এ বিষয়ে সময় দেয়া তারা প্রয়োজন মনে করেননি।

সবচেয়ে ঝুকিপ্রবণ নীচতলায় কোন কাজেই এই ঝুকি প্রবণতা প্রতিবন্ধকতা সৃস্টি করেনি। মসজিদে নামাজ পড়া, ক্যান্টিনে খাওয়া সবই চলেছে। চলেছে টিভিরুমে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইন্ডিয়ান গান বা মুভি এবং গেস্টরুমে আধিপত্যবাদী নোংরা কর্মকান্ড। একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি ডিবেটিং ক্লাব বা বাঁধনের কার্যকলাপ। রিডিং রুমের ধৈর্য্যশীল শিক্ষার্থীরাও পড়া-লেখায় মগ্ন ছিলো।

তবে সতর্ক না হলেও একটা ভীতি যে শিক্ষার্থীদের মাঝে কাজ করছিলো সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় ভূমিকম্পের সময় বিভিন্ন তলা থেকে তাদের লাফিয়ে পরা থেকে। ভূমিকম্পের সময় অনেকেই ঘুমিয়ে ছিলো- কিন্তু ঘুমের মাঝেও তাদের ভীতিকর দুঃসপ্ন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। আর তা থেকে মুক্তি পেতেই পরিণতি জেনেও হল থেকে লাফিয়ে পরা।

ভূমিকম্পের পরে ‘অতি জরুরী’ শব্দদ্বয় দ্বারা বিশেষায়িত করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কতগুলো রুম ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কয়েকবছর আগে ঝুকিপ্রবন বলে পরিত্যাক্ত করা হল অডিটোরিয়ামে শিক্ষার্থীদের সড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। টিভিরুম, রিডিংরুম এবং মুহসীন হল থেকে এক কিলোমিটারের বেশি দূরে শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট বাংলোতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এসব স্থানে যাদের জায়গা না হবে তাদের ‘নিজেদের সুবিধজিনক স্থানে’ যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাইতো বন্ধ ঘোষনা করা রুমগুলোর কিছু শিক্ষার্থী তাদের রুমকে সুবিধাজনক মনে করে এখনও থাকছেন। কিন্তু এভাবে কতদিন …..উত্তর অজানা।

হল কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র একটি ব্লককে ঝুকিপ্রবণ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য ব্লক ঝুকিপূর্ণ কিনা বা কতখানি ঝুকিপূর্ণ তা শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট নয়। ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা তো শুধু রাতের বেলায় নয়, তবে কেন হাজার-হাজার শিক্ষার্থীকে হলে থাকার অনুমতি দেয়া হচ্ছে? প্রশ্ন অনেক,কৌতুহল অনেক, আশঙ্কাও অনেক। বাস্তব উত্তর একটাই….“আমরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি”। কিšতু কর্তৃপক্ষ, আপনাদের আমলাতান্তিক মিটিং এবং তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জটিল সময়টুকুতে আমাদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রাখার কোন অধিকার কি আপনাদের আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনারা আমাদের বাবা-মা, অভিভাবক । আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপনাদের দায়িত্ব।

ঝুকির মধ্যে শুধুমাত্র মুহসীন হল নয়, ঢাকা শহরের লক্ষ-লক্ষ বিল্ডিং। বর্তমান অদ্ভুত সরকারের অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা। ভূমিকম্পের মতো কাজে গুরুত্ব দেওয়া বা অর্থ ব্যয়ের মত সময়, সুযোগ এবং পরিকল্পনা তাদের নেই। ‘এসো বাংলাদেশ গড়ি’ নামে উদ্ভট, অপ্রয়োজনীয়, অসচ্ছ এবং ফলাফলশূণ্য রোড শো করে কাড়ি-কাড়ি টাকা গচ্চা দিতে পারলেও দেশের শীর্ষ মেধাবীসহ অন্যান্য নাগরিকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা হতাশাজনক এবং আপত্তিকর।

মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা সহ ঢাকা এবং পুরো দেশের নাগরিকরা সমাধান খুঁজছে। কিন্তুু সমাধান কার কাছে এটাই এখনও তাদের অজানা।

Leave a Reply