ইতালিয়ান প্রফেসরের সাথে একদিন, বেশকিছু স্মৃতি এবং ডলারে প্রথম ইনকাম

লেখাটা ২০০৯ সালের।

Center for Excellency তে এর আগে কখনো আমি যাইনি। আমাদের বিশ্ববিদ্যায়ের মধ্যেই এত সুন্দর, পরিপারি একটা পরিবেশ আছে আগে জানতামও না। ভালো একটা আবসিক হোটেলের সবকিছুই এখানে আছে। বিদেশী যেসব মেহমান এখানে থাকেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গণরুমের নিদারুন অবস্থা তাদের জানবার কথা না। এখানে থেকে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ভাল একটা ধারণা নিয়ে যাওয়ার-ই কথা। প্রফেসর জুভ্যানি এসেছেন ইতালি থেকে। সেখানকার দক্ষিণাঞ্চলের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ান, সাংবিধানিক আইনের বিশেষজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের মেহমান। কাজের ফাঁকে ঢাকা শহরও দেখতে হবে; তাই তার গাইড হিসেবে আমার যাওয়া। এর আগেও বিদেশীদের সাথে কাজ করেছি; মোটামুটি অভিজ্ঞ বলা যায়।

পরিচয় পর্ব:

৩১ অক্টোবর, শনিবার সকাল ১১টার পরে প্রফেসর জুভ্যানির সাথে পরিচয় হল। আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. বোরহান উদ্দীন স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রফেসর জুভ্যানির নাম শোনার পর যেরকম চেহারা কল্পনা করেছিলাম, তিনি মোটেও সেরকম নন। লম্বা, ফর্সা, হাসিখুশি এক মানুষ; প্রথম দেখাতেই আমার পছন্দ হল। তিনি ব্রেকফাস্ট করলেন। এরমাঝে কুশলাদি এবং মাঝে মাঝে হাসি বিনিময় ছাড়া বিশেষ আর কোনো কথা হলো না।

যাত্রা শুরু:
ঢাকা দেখার জন্য প্রফেসর জুভ্যানি রিকসাকেই পছন্দ করলেন। আমার মানিব্যাগে দেড়শ’র মত টাকা ছিল। তিনি আমাকে ১০ ডলার দিয়ে বললেন, তোমার থেকে খরচ করো পরে আমরা হিসেব করব। মোকাররম ভবন থেকে লালবাগ কেল্লার উদ্দেশ্যে রিকসা ভাড়া করলাম ২৫ টাকায়। যাওয়ার পথে প্রথমেই শহীদ মিনারে তার কয়েকটা ছবি তুলে দিলাম। ভাষার জন্য আমাদের রক্ত দেওয়ার কথা তাকে জানালাম। তিনি ভাষার জন্য আমাদের জীবনোৎসর্গের ঘটনা শুনেছেন। এরপর জগন্নাথ হল অতিক্রম করে স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখিয়ে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যটা দেখালাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব সলিমুল্লাহসহ নবাব পরিবারের অবদানের কথা তাকে জানালাম এসএম হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। রিকসা পলাশী থেকে বা দিকে মোড় নিয়ে লালবাগের দিকে যেতে লাগল।

পার্ট অফ আ ভিডিও গেম:
রিকসায় প্রফেসর খুব আরামদায়কভাবে বসেছেন এমনটা মনে হলো না। তবুও তিনি আলাপের ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলছিলেন। এরমধ্যেই রিকসাময় পুরান ঢাকার জ্যাম শুরু হলো। জুভ্যানির ভাল লাগছে। আমাকে বললেন, ভিডিও গেম দেখেছো, অনেক গাড়ি থাকে, ক্রস করার প্রতিযোগিতা থাকে, ধাক্কা লাগে। আমি বললাম, হ্যাঁ। ‘আমরা হলাম সেই ভিডিও গেম এর একটা পার্ট, রিকসাগুলো হলো ভিডিও গেমের গাড়ি’- তিনি আমাকে জানালেন। না হেসে উপায় আছে কি?

লালবাগ কেল্লায়:

টিকেট কাটতেই আমার ১১০টাকা শেষ হয়ে গেল (বিদেশীদের জন্য ১০০ টাকা)। লালবাগ কেল্লায় প্রফেসর মুগ্ধ। বসার মত গাছের ছায়া বা জায়গা আছে এমন সবগুলোই জুটিতে পরিপূর্ণ। কাছাকাছি বসে গায়ে গায়ে লেগে থাকা এমনকি চুম্বন দৃশ্যও একটু পরপর দেখা যাচ্ছিল। পুরো বাংলাদেশ যে এরকম নয় এবং এখানে যারা এসেছে তাদের বেশিরভাগই যে পরিবারকে ফাকি দিয়ে সবার অজান্তে এসেছে সেটা তাকে বললাম। আমাদের গ্রামগুলোতে যে এটা একেবারেই অসম্ভব সেটাও বললাম। তিনি জানালেন, তাদের দেশে এটা স্বাভাবিক। তিনি নিজেও প্রেম করে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী আইনজীবী, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। তবে ২০ বছরের ছেলেটি আইন পড়েনি, ইঞ্জিনিয়িিরং পড়ছে। তার ছেলেরও একটা বান্ধবী আছে এবং তিনি ও তার স্ত্রী দু’জনেই তাকে চেনেন।

কেল্লার জাদুঘরে: বকশিষ এবং খানিকটা লজ্জা:
জাদুঘরের নিচতলার কর্মচারীটি বিদেশী দেখেই এগিয়ে এলেন। অনর্গল ইংরেজি বলা শুরু করলেন। আমি কিছুটা অবাক। তবে একটু পরেই বুঝতে পারলাম ওর ইংরেজিগুলো ভুল-শুদ্ধমিশ্রিত কিছূ মুখস্থ বাক্য। তারপরও প্রফেসর যে একটা ভালো ধারণা পাবেন, সেটা নিশ্চিত। তবে কর্মচারীর এই আগ্রহ এবং আন্তরিকতার মূলে হলো বকশিষ পাওয়ার বিষয়টি। দোতলায় উঠার আগে প্রফেসর তাকে ১০০ টাকা বকশিষ দিলেন। দোতলায়ও একই কান্ড। জুভ্যানির কাছে আর ১০০ টাকা আছে, বাকীগুলো ডলার। আমাকে বললেন বকশিষটা মিটিয়ে দিতে, আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। আমার পকেটে তখন ছিল ৫০ টাকা। নামার সময় কর্মচারীকে ৩০ টাকা দিতে চাইলাম। আমাদের কাছে যে আর টাকা নেই সেটা তাকে বললাম এবং বিদেশীদের থেকে বকশিষ আদায়ে আমিও যে পক্ষপাতি সেটাও বললাম। কিন্তু বয়স্ক কর্মচারী আমাকে যা বলল তাতে আমি হতবাক- ‘আমি ভিক্ষুক না, এই টাকা দিয়া তুমি চা খাইও।’ কিছুটা রাগ হলো। প্রফেসর ব্যাপারটা দেখে ফেলেছেন, তিনি জানতে চাইলেন কি হয়েছে, আমি পরলাম অশ্বস্তিকর অবস্থায়। বললাম, ‘উনি আসলে টাকা নিতে চাচ্ছেন না’। প্রফেসর বললেন, হ্যা ঠিক আছে তো; তোমার থেকে উনি নিবেন কেনো, তুমি তো ছাত্র। বকশিষতো আমি দেব। এই বলে তিনি তার শেষ ১০০ টাকা দিয়ে দিলেন!


বিপদ এবং…….

বিপদ হলো টাকা নিয়ে। আমার কাছে আছে ৫০ টাকা। আর প্রফেসরের কাছে নেই মোটেও; আছে ডলার। এরপর যাব আহসান মঞ্জিলে। শামীম নামের এক বন্ধুকে ফোন করলাম, যে ঐদিকে থাকে। বললাম কিছু টাকা নিয়ে আসতে। লালবাগ থেকে আহসান মঞ্জিল যাওয়ার পথে চকবাজার এবং ইসলামপুরে ডলার ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হলাম। শনিবার এবং সময় ২ টার পর হওয়ায় বেশিরভাগ ব্যাংক বন্ধ। দু’একটা খোলা পেলাম কিন্তু ডলার ভাঙ্গানোর সুযোগ পেলাম না। প্রফেসর বললেন, ইউ আর মাই ব্যাংক। আমার কাছে টাকা নেই তখনও তাকে সেটা বলিনি। চকবাজার-ইসলামপুরের ভীষণ জ্যামে দু’জনেই বিরক্ত হয়ে গেলাম। এরমধ্যে জুভ্যানি কয়েকটা বাংলা শব্দ এবং বাক্য মুখস্ত করে ফেলেছে। ঢন্নবাদ (ধন্যবাদ), আবার দ্যেখ্যা হ্যবে (আবার দেখা হবে), ডান দে (টান দে, সামনে যা), বায় যা (বায়ে যা), ডাইনে যা (রিকসা ওয়ালাদের থেকে শেখা)। চকবাজারের এক গলিতে যেখানে রাস্তা প্রচন্ড খারাপ ছিল, সেখানে যাওয়ার সাথে সাথে রিকসা প্রচন্ডভাবে দুলতে শুরু করল। দু’জনেই পরে যাই যাই অবস্থা। এরমাঝে প্রফেসর মজা করে বলে উঠলেন, দিস ইজ দ্য মোস্ট ডিফিকাল্ট পার্ট আব দ্য ভিডিও গেম।
আহসান মঞ্জিলে নেমে ৪০ টাকা রিকসা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। খুচরা ৪ টাকা না নাকায় টিকিট কাটতে ৫ টাকা দিতে হলো। অর্থাৎ আমার কাছে তখন আছে মাত্র ৫ টাকা। ভিতরে ঢুকে শামীমকে পেলাম; কিন্তু কোনো টাকা আনতে পারেনি। আমারতো মেজাজ পুরা খারাপ হয়ে গেল। এখন কি করা যায়। এরপর বুড়িগঙ্গায় নৌকায় চড়তে হবে। দুপুরে খেতে হবে, ফিরতে হবে। কি করি, কি করি……এমন সময় একটা বান্ধবীর কথা মনে পড়ল, ইংলিশ রোডে বাসা। ফোন করলাম; ৩০০ টাকা চাইলাম। ম্যানেজ হলো। কিন্তু নিয়ে আসতে কম করে হলেও ৩০ মিনিট প্রয়োজন। শামীমকে পাঠালাম। যাওয়ার সময় আমার কাছে থাকা শেষ ৫ টাকাও নিয়ে গেল। আমি তখন টাকাশূণ্য ডরারধারী; জীবনে প্রথমবারের মত। প্রফেসরকে পুরো ঘটনা বললাম। সে স্বাভাবিকবাবেই নিল বিষয়টা। আরো কিছু আলাপ এবং ঘুরাফিরার পর জ্যুভ্যানি বাইরে যেতে চাইল। বাইরে বের হলাম।

ইসলামপুরী ঝামেলা

আহসান মঞ্জিলের পাশেই্ মার্কেটের একটা দোকানে লাল রংয়ের একটা কাপড় পছন্দ হল জ্যুভ্যানির; স্ত্রীর জন্য। ডলারে বিক্রি করবে এমন শর্তে কাপড় কিনতে রাজি হলাম। ১ মিটার কাপড় দাম চাইল ৫২৫ টাকা। ৫০০ টাকায় দিতে রাজি হল। ডলারের বিনিময় মূল্য হবে ৭০ টাকার বদলে ৬৫ টাকা। আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ১০ ডলার দেয়ার পর বলল এত কম ডলার ভাঙ্গাতে সমস্যা হবে। ৬০ টাকা করে দিব। আমি অবাক, বিরক্ত। ঝগড়া বেধে গেল। একে অপরকে দেখে নেওয়ার পালা পর্যন্ত গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উচ্চারণের পর অনেকটা নমনীয় হল। শেষ পর্যন্ত ৬৫ টাকায় বিনিময় হল। প্রফেসর পুরো বিষয়টাতে অবাক দর্শক। ঝামেলা শেষ করে তাকে ঘটনা বললাম। খুব বেশি অবাক হলো না। আসার সময় এমন ভাব দেখিয়ে আসলাম যে, দোকানের নাম চিনে গেলাম। দেখে নেবো।

বুড়িগঙ্গার নোংরা জলে:
নৌকায় ওঠার আগে সজীব নামের ক্লাস টু এর ্একটা ছেলের সাথে পরিচয় হলো। প্রফেসর আমাকে কিছু টাকা দিতে বললেন সজীবকে। আমি ১০ টাকা দিলাম। এরমধ্যে শামীম চলে এসেছে। সজীবও আমাদের সাথে নৌকায় উঠল। বুড়িগঙ্গা নামটা জ্যুভ্যানি মুখস্ত করে ফেলেছেন। নোংরা, দুর্গন্ধময় জলের উপর দিয়ে আমাদের নৌকা চলতে লাগল। প্রফেসর বেশ মজা পাচ্ছেন বলেই মনে হল। অনেক ছবি তুলছিলেন, কারো কারো সাথে হাই-হ্যালো বিনিময়ও করছিলেন। তাকে বললাম বুড়িগঙ্গাকে বাাঁচাতে ঢাকাবাসীর কর্মসূচীর কথা। আইনি পদক্ষেপের কথাও বাদ গেলো না। জানালাম, সর্বোচ্চ আদালত দুষণ বন্ধ করতে আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং…….
পুরো সময়টাতে প্রফেসর জ্যুভ্যানির থেকে অনেক কিছুই শেখার ছিল। বাংলাদেশ দেখে কিছু অবাক প্রশ্নও তার ছিল। যেমন একবার আমাকে বললেন, ‘তোমরা ৯০% মুসলিম কিন্তু তোমাদের মেয়েদের দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই, কারণ ওরা হিজাব পরে না।’ যেসব শিশুদের তিনি কাজ করতে দেখেছেন ওরা সবাই স্কুলে যায় কিনা, না গেলে কেন যায় না..ইত্যাদি আরো অনেক প্রশ্ন। তবে তিনি আমাকে জানালেন, তার দেশ যদিও ১০০% শিক্ষিত বলে দাবী করে আসলে তিনি নিজে এমন অনেক জায়গায় গিয়েছেন যেখানে অনেক শিশু স্কুলে যায়না। শিশুদের অভিভাবক ছাড়া বাইরে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। অহরহ অপহরণ হয়। প্রফেসর জ্যুভ্যানি ৬ টা ভাষা জানেন। ইংরেজি, ইটালিয়ান, জার্মান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং স্থানীয় আরেকটি ভাষা। আর তার স্ত্রী আরবী জানেন, কারণ লেবাননে বড় হয়েছেন। এদেশের আইনের শিক্ষার্থীরা ডিপলোম্যাট হতে চায় কিনা, তিনি প্রশ্ন করলেন। আমি জানালাম, না। কারণ আইনজীবীর আয় বেশি। কিন্তু ইতালীতে বেশিরভাগই ডিপলোম্যাট হতে চায়, কারণ আইনজীবীর চাইতে ডিপলোম্যাটদের আয় বেশি।

বকশিষ পর্ব:
রুমে ফিরে প্রফেসর আমাকে ২০ ডলার বকশিষ দিলেন। আমি যতটা সম্ভব না নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি বললেন, ‘ আই অ্যাম মোর এক্সপার্ট ইন কাউন্টিং দ্যান ইউ।’ কি আর করা খুশিতো হলামই; এটাইযে ডলারে জীবনের প্রথম ইনকাম। এছাড়াও ১ ইউরো তিনি আমাকে দিয়েছন। ঠিকানা বিনিময় হল। ই-মেইলে যোগাযোগ হবে তিনি আশ্বাস দিলেন। বাংলাদেশ থেকে তিনি নেপাল যাবেন। সেখানে নতুন সংবিধানের খসড়া হবে, তিনি সেই কমিটির সদস্য।
এরপর আইন অনুষদে তাকে নিয়ে এলাম। ডিন স্যারের রুমে আরো কয়েকজন শিক্ষকের সামনে আমার প্রশংসা করলেন। প্রসংশায় কার না ভালো লাগে…..?

Leave a Reply